গতকাল শনিবার রাতে ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য বৃহত্তর সংঘাতের একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এ মাসের শুরুতে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ঊর্ধ্বতন তিন ইরানি জেনারেলসহ ১২ জন নিহত হয়েছিলেন। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ইরানের আল-কুদস বাহিনীর শীর্ষ এক কমান্ডার ছিলেন, যিনি সিরিয়ায় ইরানি বাহিনীর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন।
ইসরায়েলে তিন শতাধিক ড্রোন ও মিসাইল হামলার পর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার উদ্বেগটা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি এক বিবৃতিতে বলেন, গতকাল রাতে ইরান তিন শতাধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল ছোড়ে। তিনি বলেন, ১৭০টি ড্রোন ও ৩০টি ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। এর একটিও ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। ১১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়, এর মধ্যে কয়েকটি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে।
এর আগে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছিলেন যে ইসরায়েলে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে ইরান। শিগগির হোক আর দেরিতে হোক, তারা হামলা করবেই। এ ধরনের হামলা না করার জন্য তিনি ইরানকে সতর্কও করছিলেন। দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে আকাশপথে হামলার দায় স্বীকার করেনি ইসরায়েল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলাকে ইরানের মাটিতে ঢুকে হামলার সমতুল্য উল্লেখ করে ইসরায়েলের উদ্দেশে বলেছিলেন, তাদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছিলেন, ইরান যদি তাদের ভূমিতে হামলা চালায়, তারা তাহলে সরাসরি ইরানে আক্রমণ শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ইসরায়েলকে তার দেশ লৌহদৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীন ও অন্য কয়েক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, তারা যেন ইরানের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে ইসরায়েলে হামলা করা থেকে ইরানকে সংযত থাকতে বলে। চীন ও ভারত ইরানকে সংযত থাকার আহ্বান জানায়।
রাশিয়া, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতি সংযম দেখানোর আহ্বান জানায়। ভারত এরই মধ্যে ইরানের আকাশপথে বিমান চলাচল স্থগিত করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংবাদ সম্মেলন করে সতর্ক করেন, ‘ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ একটা বৈশ্বিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। আমি ঠিক জানি না, এ সময় বাইডেন আসলে কী করছেন।’
এর মধ্যে জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২২ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওপেক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত বাড়ছিল। ইরান–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো হামাসের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে লেবানন, ইরাক ও সিরিয়া থেকে হামলা করে আসছিল। মিত্রগোষ্ঠীদের সমর্থন দিয়ে গেলেও ইরান এত দিন ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলার পথ নিয়েছিল। কিন্তু দামেস্কে কনস্যুলেট ভবনে হামলার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের বিরোধ চলে আসলেও তেহরান কখনোই তেল আবিবের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নামেনি। দামেস্কের ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরান সেটা করল।
কিন্তু এরপর কী হতে চলেছে, সেটা নির্ভর করছে ইসরায়েল এই হামলার জবাবে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়, তার ওপর।
ইরান এখন ইসরায়েল ও বাইডেন প্রশাসনকে সতর্ক করেছে যে তারা এখন পরবর্তী প্রতিশোধ নেবে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের সামরিক পদক্ষেপে ইসরায়েল যদি প্রতিশোধ নেয়, তাহলে আজকের রাতের চেয়ে ভয়াবহ মাত্রায় হামলা চালানো হবে।’ বাঘেরি তার বিবৃতিতে আরও বলেন, সুইজারল্যান্ডের মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে তেহরান সতর্ক করে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলি প্রতিশোধে কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাহলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান–ইসরায়েল সংঘাত আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকলেও, পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ডের নৌবাহিনীর প্রধান আলিরেজা তাংসিরি গত মঙ্গলবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইসরায়েলের উপস্থিতিকে তাঁরা হুমকি বলে মনে করেন। কেননা, এটা হরমুজ প্রণালির খুব কাছে। প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল বিক্রি হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন করা হয়।
ইরানের দিক থেকে ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে, এ খবরেই গত অক্টোবর মাসের পর তেলের দাম সর্বোচ্চ ছুঁয়েছিল। আর গতকালের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল পরিবহনে বড় বাধার সৃষ্টি হতে পারে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে অপরিশোধিত তেলের দাম ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৯২ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর দাম এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
এর মধ্যে জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২২ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওপেক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
দ্য ইকোনমিক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত