রক্তে কেনা ডলার খেল কালো বিড়ালে

দেশের অর্থনীতি ভালো নেই। জিনিসপাতির দাম যে বেড়ে গেছে, তা বুঝতে অর্থনীতির পণ্ডিত হতে হয় না। বাসভাড়া বেড়ে গেছে, লোডশেডিংয়ে জীবন জেরবার। গ্লোবাল টাইমস (আগস্ট ৪, ২০২২) বলছে, ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৭৮ ডলার। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৪০ ভাগ।

এসবের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয় করোনা-উত্তর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে, যেখানে আমদানি বেড়ে গেছে, রপ্তানি বাড়েনি তুলনায়; ইউক্রেন যুদ্ধ; রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, তেলের মূল্যবৃদ্ধি; ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সমস্যা ইত্যাদি।

কিন্তু এসবের আড়ালে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। তা হলো, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ডলার পাচার। ২০২০ সালের তথ্য: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) এর পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০২০)।

১১ আগস্ট ২০২২ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় একটা সহজ-সরল নিবন্ধ লিখেছেন ড. রাকিব আল হাসান। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের ডলারসংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি আর রপ্তানি আয়ের কমে যাওয়াকে। কিন্তু একটা বড় কারণ আমরা আলোচনার বাইরে রাখছি। আর তা হলো, বিদেশে ডলার পাচার হয়ে যাওয়া। কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়? তাঁর লেখা থেকে যা বুঝেছি, সহজ ভাষায় নিজের মতো করে বলি। একটা হলো, ওভার ইনভয়েসিং। মানে আমি ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করব, দেখালাম পণ্যের দাম ১৫০ টাকা। এর ফলে ৫০ টাকা পাচার হয়ে গেল। রপ্তানির ক্ষেত্রে করা হয় উল্টোটা। ১০০ টাকার পণ্য রপ্তানি করলাম, কিন্তু দেখলাম আয় হচ্ছে ৫০ টাকা। বাকি ৫০ টাকা বিদেশে রয়ে গেল। আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে হুন্ডি। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির তথ্য থেকে একটা চমকপ্রদ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্যাটার্ন পাওয়া যায় ডলার পাচারের, আর তা হলো, নির্বাচনের আগে আগে ডলার পাচারের হার যায় বেড়ে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে বিদেশে টাকা পাচারের হার বেড়ে গিয়েছিল ৫০ শতাংশ।

বিদেশে যে ডলার পাচার হয়, সেটা তো এখন বাজেটেই স্বীকৃত। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে আপনারা বাধা দিয়েন না। এই টাকা ফেরত আনতে না পারলে তো কোনো লাভ নেই।’

সুইস ব্যাংকে টাকা আছে বাংলাদেশিদের। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আছে বাংলাদেশের ৯০ ব্যক্তি ও ৭ প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে পানামা পেপারসে নাম আসে ৬১ ব্যক্তি ও ৭ প্রতিষ্ঠানের। প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসে ২৯ ব্যক্তির। কিন্তু চার বছর পার হলেও এসব অর্থ পাচারকারীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। ফলে অর্থপাচারকারী ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান থাকছে অধরা। এমনকি পাচারের তালিকায় নাম আসা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চার বছর ধরে তথ্য চেয়েও তা পায়নি দুদক। হাইকোর্টে রিট হয়েছে। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘২০১৬, ২০১৭ সালের ঘটনা, কিন্তু এখনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাদের ব্যাপারে আপডেট জানতে চাচ্ছি। এখনই শুরু না করলে দূরে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অন্তত শুরু করতে না পারলে এগুলো বাদ দেওয়ার কথা বলে দেন। আমাদেরও তো দেশের প্রতি কিছু দায়িত্ব আছে। এসব চিন্তায় মাঝে মাঝে ঘুম হয় না।’(আমাদের সময়, ৭ ডিসেম্বর ২০২১)। সম্প্রতি আদালত বলেছেন, ‘শুধু চিঠি চালাচালি যথেষ্ট নয়। তদারক করতে হবে। সচেতনভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজ কিছু করে দেখান। মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতি নিয়ে আমরা কনসার্ন (উদ্বিগ্ন), এগুলো কমাতে হবে। কারা টাকা পাঠিয়েছে, তা বের করতে এখন দুই দেশের (দ্বিপক্ষীয়) চুক্তি হওয়া উচিত।’ ... আদালত বলেন, ‘ভারত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। এ নিয়ে রায়ও আছে। ওই রায় পড়েন। তারা পারলে আমরা কেন পারব না?’

আজকের এই অর্থনৈতিক সংকটের পেছনের বড় একটা কারণ দুর্নীতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া। সরকার যদি একটা ক্রাশপ্রগ্রাম নেয়—আমি বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ট্র্যাক করব আর তাদের শাস্তি দেব, তাদের বাধ্য করব দেশের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে, তা অসম্ভব বলে মনে হয় না। সরকার চাইলে কেঁচো খুঁড়তে পারবে না, তা হয় না। কেঁচো খুঁড়তে গেলে কেউটে সাপ বেরোবে, বের হোক, কেউটে সাপকেই দমন করতে হবে!

প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিচের খবর পড়লে আপনার রক্ত হিম হয়ে আসবে—‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নানা অনিয়ম ও নিরীক্ষা আপত্তি দেখে “স্তম্ভিত” জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় বিপিসির তিনটি অর্থবছরের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা (অডিট) আপত্তির কথা উঠে এসেছে, যার সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা জড়িত। সভায় জানানো হয়, একটি নিরীক্ষা আপত্তিতে বিপিসির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ... একটি আপত্তিতে হিসাব ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, বিপিসির স্থিতিপত্রে (ব্যালান্স শিট) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে দেওয়া ঋণের যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে ওইসব প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের স্থিতিপত্রে দেখানো অঙ্কে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার গরমিল দেখা গেছে। নিরীক্ষার সময় বিপিসি এই গরমিলের ব্যাপারে কোনো জবাব দেয়নি। নিরীক্ষায় অনুসন্ধান করে এই গরমিলের সঙ্গে কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিপিসি কিছুই করেনি। পরে ওই আপত্তি জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাবসংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ২২ মে কমিটি দুই মাসের মধ্যে নিরীক্ষা অধিদপ্তরে নথিপত্র দিতে বিপিসিকে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু তারা কমিটিকে কোনো নথিপত্র সরবরাহ করেনি।’

আমাদের এই আর্থিক সংকট, তেলসংকট, ডলারসংকটের পেছনের একটা বড় কারণ দুর্নীতি। আমি একজন সাংবাদিক, আমি একজন প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, মাদক ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি,সরকারের উচ্চপদে নিয়োজিত ব্যক্তি, নেতা, পাতিনেতা, এলাকার মাস্তান, ক্যাসিনো ব্যবসায়ী, নারী পাচারকারী, ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী, ফাঁকিবাজ ঠিকাদার, ভূমিখেকো, বনখেকো, নদীখেকো, আমি একজন শর্ষে, যার নিজের মধ্যে ভূত আছে; আমি আমার অবৈধভাবে অর্জিত টাকা কী করব? বিদেশে পাচার করব। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, তুরস্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনব, পাসপোর্ট কিনব; বেগমপাড়া বানাব এবং নির্বাচনের আগে বিপুল বেগে এই পাচার চালাব। কারণ আমি সরকারের ছায়ার নিচে আছি কিংবা আমিই বটগাছ, নিমগাছ, বিষকাটালির গাছ, আমিই ছায়া দিই সরকারকে।

আজকের এই অর্থনৈতিক সংকটের পেছনের বড় একটা কারণ দুর্নীতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া। সরকার যদি একটা ক্রাশপ্রগ্রাম নেয়—আমি বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ট্র্যাক করব আর তাদের শাস্তি দেব, তাদের বাধ্য করব দেশের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে, তা অসম্ভব বলে মনে হয় না। সরকার চাইলে কেঁচো খুঁড়তে পারবে না, তা হয় না। কেঁচো খুঁড়তে গেলে কেউটে সাপ বেরোবে, বের হোক, কেউটে সাপকেই দমন করতে হবে!

এই সুযোগে ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে কি একটু উদ্ধৃতি দেব? ‘দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয়। এর ফলে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ।... প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন।’ (সারাবাংলা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮)

চোখ ধাঁধানো আলোর নিচে নিজের কৈশোর নিঃশেষে দান করে সেলাই মেশিনে নিজেদের বিন্দু বিন্দু রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন আমাদের নারীরা। মধ্যপ্রাচ্যে গনগনে রোদের নিচে নিজের সব আয়ু ঢেলে দিচ্ছেন আমাদের শ্রমিকেরা। সেই রক্ত-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত ডলার আমাদের লুটেরা ধনিকেরা, কালো টাকার মালিকেরা, দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবানেরা এবং কর্মকর্তারা, নানা ধরনের কালোবাজারিরা বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে অবলীলায় পাচার করছেন। বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ছেন।

এবার এর বিরুদ্ধে চাই জাতীয় আন্দোলন। তার ডাক আসতে হবে উচ্চপর্যায় থেকে। আর তাতে যোগ দিতে হবে সব শ্রেণির জনগণকে এবং ঠগ বাছাই শুরু করতে হবে কাছের মানুষদের মধ্যে থেকে। ওপরের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হলে চুনোপুঁটিরা এমনিতেই দমিত হবে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক