মতামত

কার মনোনয়ন কী কারণে বাতিল বা কী কারণে বহাল

আচরণবিধি ভেঙে অনেক প্রার্থীকেই মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেখা গেছে
ফাইল ছবি

নির্বাচন এলেই ঋণখেলাপি ও বিলখেলাপিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগে তাঁরা কিস্তি দিয়ে নিজেদের সাচ্চা দেশসেবক হওয়ার বাসনা পূর্ণ করেন। দেশ সেবক হওয়ার পর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায়। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হোক না হোক, ঋণ নেওয়ার প্রতিযোগিতা থাকবেই।

গত ২ অক্টোবর প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান সংসদের এমপিদের ভাগে কত আছে সেটা বের করা কঠিন নয়।

বিএনপিবিহীন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতা চলছে। আওয়ামী লীগ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, সমাবেশ করতে তাদের অনুমতি লাগবে। নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজের কথায় ধরা খেয়েছে। বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে কমিশনের পদাধিকারীরা বললেন,  ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ। এরপরই প্রচারে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয় আসবে। তাহলে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করতে ইসির অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য ঠিক হলে সমাবেশের জন্য অনুমতি নিতে হবে। তিনি বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ইসি আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সমাবেশের বিষয়ে ইসি কী সিদ্ধান্ত নেয়, দেখার অপেক্ষায় আছি।

এর আগে নির্বাচন কমিশন যেসব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনেকেই নির্বাচনের আগেই প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের প্রথম দুই দিনেই অনেক জাঁদরেল প্রার্থী ধরা খেয়েছেন। কে কী কারণে ধরা খেয়েছেন, তার কিছু কিছু খবর সংবাদমাধ্যমেও এসেছে।

মিজানুর রহমানের ভাষায়, ‘যারা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান করবে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’ নির্বাচনী আচরণবিধি মানাতে তৎপর নির্বাচন কমিশন এর জবাবে কী বলবেন? একজন ছাত্রলীগ নেতা কীভাবে বলেন, নৌকা প্রার্থী ছাড়া এখানে কেউ ভোট করতে পারবে না।

পত্রিকার  খবর অনুযায়ী, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। মনোনয়ন ফরম তুলেছিলেন রাজশাহী-১ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের জন্য। তবে দলের মনোনয়ন পাননি তিনি। দল মনোনয়ন না দেওয়ায় রাজশাহী-১ থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন এই নায়িকা। কিন্তু ১ শতাংশ ভোটার জালিয়াতির (ভুয়া স্বাক্ষর) অভিযোগে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে রাজশাহী নির্বাচন কমিশন অফিস।

মনোনয়নপত্র বাতিলের প্রতিক্রিয়ায়  তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘জেদ’ একটা মারাত্মক ম্যাজিক্যাল জিনিস। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, একটা মানুষের পজিটিভ জেদ ওই মানুষটাকে দিয়ে কী কী করাতে পারে। আপনি কাউকে একবার খাবার নিয়ে খোঁটা দিন, দেখবেন পরবর্তী সময়ে সে না খেয়ে থাকছে কিন্তু আপনার কাছে কখনোই খাবার চাচ্ছে না। আপনি কাউকে কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে অপমানিত করুন, দেখবেন বেশির ভাগ মানুষই সেই জায়গাটায় আর ফিরে যাচ্ছে না।’’ এর মাধ্যমে তিনি কাকে কী বার্তা দিলেন?

কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হলফনামায় মামলা ও ঋণের তথ্য না দেওয়ায় তথ্য গোপন করার কারণ উল্লেখ করে তাঁর মনোনয়নপত্রটি বাতিল ঘোষণা করা হয়।

৮৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১১ টাকা বকেয়া কর পরিশোধ না করায় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও পটুয়াখালী-১ আসনে জাপা মনোনীত প্রার্থী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়নপত্র স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরও দুই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল ও একজনের মনোনয়ন স্থগিত রাখা হয়। বাতিল হওয়া দুজন হচ্ছেন বাংলাদেশ কংগ্রেসের নাসির উদ্দীন (ঋণখেলাপি) এবং জাকের পার্টির মিজানুর রহমান (ঋণখেলাপি)।

এ ছাড়া কাগজপত্রে গরমিল থাকায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের মহিউদ্দিন মামুনের মনোনয়ন স্থগিত রাখা হয়েছে। রোববার সকাল ১০টায় পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় তিনটি মনোনয়নপত্র স্থগিত করেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নূর কুতুবুল আলম।

পটুয়াখালী-২১ সার্কেল সহকারী কর কমিশনার মো. মাসুদ রানা জানান, জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের ২০০০ থেকে ২০০৮-০৯ সাল পর্যন্ত ৮৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১১ টাকা কর বকেয়া রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজস্ব আইনে বিচারাধীন মামলা রয়েছে।

একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি একটি দলের কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মহাসচিব, তিনি ২০০০ সাল থেকে সরকারের কর বকেয়া রেখেছেন, এটা কী ভাবা যায়! কর বকেয়া রেখে তিনি এত দিন নির্বাচন করলেন কীভাবে?

ঋণখেলাপি হওয়ায় কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। এখানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রার্থী বিএনপির সাবেক নেতা মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, বাতিল হয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের মনোনয়নপত্র।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেও শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করতে হলে এক শতাংশ ভোটারের সইসহ মনোনয়নপত্র জমা দিতে হতো।

এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার যে সদ্য আওয়ামী লীগে আসা শাহজাহান ওমর আর বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সামনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ থাকল না।

এদিকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতা ও বর্তমান সংসদের সদস্য মাহি বি চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ঋণ খেলাপের অভিযোগে। দলের সাধারণ সম্পাদক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবদুল মান্নানের মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়েছে একই কারণে। তাহলে এই দলের বেশির ভাগ নেতাই কি ঋণখেলাপি?  ব্যাংকের টাকা কোথায় যায়, জনপ্রতিনিধিদের খেলাপি ঋণের হিসাব নিলে কিছুটা জানা যাবে।

গায়িকা ডলি সায়ন্তনীর মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ অন্য। জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মু. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, ক্রেডিট কার্ড-সংক্রান্ত খেলাপি ঋণের কারণে ডলি সায়ন্তনীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে ডলি বলেন, ‘কার্ডের বিষয়টি আমার নলেজে ছিল না। বিষয়টি আমি দ্রুত সমাধান করে আপিল করব। আপিলে আমার মনোনয়নপত্র ফিরে পাব বলে আশা করছি।’ তাঁর ভক্তরাও নিশ্চয়ই চান তিনি মনোনয়ন ফিরে পান।

নির্বাচন এলেই আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম শিরোনাম হন। বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) আসনে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তা বাতিল হয়ে যায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেওয়ায়। কাহালু-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) আসনে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ কংগ্রেস দলের হয়ে। এক দলের নামে মনোনয়নপত্র তুলে অন্য দলের নামে জমা দেওয়া থেকে বোঝা যায় নির্বাচনটি কেমন হবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে বগুড়া-৬ (সদর) ও বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন হিরো আলম। পরে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনেও অংশ নেন তিনি। শেষ নির্বাচনে হিরো আলম আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিতও হন।

গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ভিন্ন কারণে। মনোনয়নপত্রে মোকাব্বির খান নিজেকে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি। গণফোরাম ইতিমধ্যে কয়েক টুকরো হয়েছে। এই দলের আরেক নেতা সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল অন্য প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন।

তবে নির্বাচন কমিশন মনোনয়নপত্র  যাচাই বাছাই করার আগেই পাবনা-৩ আসনে নৌকা প্রার্থী ছাড়া অন্যদের মনোনয়নপত্র ‘বাতিল’ করে দিয়েছেন সেখানকার এক ছাত্রলীগ নেতা। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান সবুজ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘পাবনা-৩ আসনে মকবুল হোসেন ছাড়া কেউ ভোট করতে পারবে না।’

মিজানুর রহমানের ভাষায়, ‘যারা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান করবে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’ নির্বাচনী আচরণবিধি মানাতে তৎপর নির্বাচন কমিশন এর জবাবে কী বলবেন? একজন ছাত্রলীগ নেতা কীভাবে বলেন, নৌকা প্রার্থী ছাড়া এখানে কেউ ভোট করতে পারবে না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    ই–মেইল: sohrabhassan55@gmail.com