গাজার এক দিক থেকে আরেক দিকে ছুটছেন ফিলিস্তিনিরা। ক্লান্ত হয়ে এক নারী বসে পড়েছেন। পেছনে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি।
গাজার এক দিক থেকে আরেক দিকে ছুটছেন ফিলিস্তিনিরা। ক্লান্ত হয়ে এক নারী বসে পড়েছেন। পেছনে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি।

যে দুই ব্যক্তি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধ করতে পারেন, কীভাবে?

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত হলেও একটা ইতিবাচক দিক আছে। ইসরায়েলের পাশে পৃথক একটি রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অভ্যুদয় ও দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনায় চারটি পক্ষ—ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সঙ্গে এই চারটি রাষ্ট্রের কী কী স্বার্থ জড়িত চলুন দেখা যাক।

যুদ্ধ শেষে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে ইসরায়েলেরই লাভ। এই দেশটির বেশ কিছু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তারা সেই সুযোগ পাবে। গাজা থেকে বের হতেও এখন এটিই একমাত্র পথ। উপরন্তু নিজের সুরক্ষার জন্য ইসরায়েলের যে আঞ্চলিক মৈত্রী প্রয়োজন, সে জন্যও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা জরুরি।

আমি বুঝতে পারছি ইসরায়েলি সমাজ ৭ অক্টোবরে হামাসের আকস্মিক হামলার ভীতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারা আর ফিলিস্তিন ‘রাষ্ট্র’ নিয়ে কিছু শুনতে চায় না, এমনকি পুরোপুরি অসামরিক হলেও নয়। কিন্তু গাজা যুদ্ধের কয়েক বছর আগেও ইসরায়েলে এই আলোচনা ছিল। এখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হবে বড় ভুল। ইসরায়েলের উচিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আকার-প্রকার নিয়ে আলোচনা করা। এই ধারণাকে এড়িয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়।

ইসরায়েল যদি হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণা এড়িয়ে গাজা ও পশ্চিম তীরকে পুরোপুরি দখলে নিতে চায়, তাহলে সারা বিশ্বে ইসরায়েল একঘরে হয়ে থাকবে, বিশেষ করে আরব বিশ্বে। বলাই বাহুল্য, ইসরায়েলের আরব মিত্ররাও ইহুদি রাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবে।

ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চিরস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক যে কৌশল গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে ইসরায়েল, মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোর মধ্যে, সেটি চাপে পড়বে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ওই অঞ্চলে টিকে থাকা মুশকিল হবে। রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গাজার হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যুতে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আরব দেশগুলোতে তার যে সামরিক ঘাঁটিগুলো রয়েছে, সেগুলো পরিচালনায় কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ে ইরানের যে ‘দুষ্ট’ চক্র, সেটি প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেগ পেতে হচ্ছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য সৌদি আরবের প্রয়োজন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র–সম্পর্কিত একটি রূপরেখা। সৌদি আরব জানে মার্কিন কংগ্রেসে সমর্থন আদায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের প্রধান শর্তই হলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ।

এক টুকরো রুটির জন্য বেকারিতে ফিলিস্তিনিদের ভীড়। গাজায়

মোদ্দা কথা হলো মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর একটি বেসামরিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরুর প্রয়োজনীয়তা এত তীব্রভাবে আর অনুভূত হয়নি।

ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ ইসরায়েলের পাশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে এসেছে। এখন তা পূরণের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই কাজ অবিশ্বাস্য রকমের দুরূহ বলে ফেলে রাখার অর্থ হয় না। এ থেকে দূরে থাকার অর্থ হলো রাষ্ট্র গঠনে যে জটিল ইস্যুগুলো আছে, সেগুলোর মুখোমুখি হতে না চাওয়া।

ফিলিস্তিনিদেরও উচিত হবে ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় মনোযোগী হওয়া, এবং পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গুণগত মানের উন্নয়নে এখন, আজই, জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া।

সোজাসুজি বললে, দুটি পক্ষ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিপক্ষে। তারা খুবই শক্তিশালী। এর একটি হলো হামাস, যারা ইসরায়েলকে বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়। এর প্রমাণ তারা ৭ অক্টোবর রেখেছে। অপর পক্ষ হলো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর ডানপন্থী মিত্ররা। তারা শুধু হামাসেরই ধ্বংস চায় না, তারা পশ্চিম তীর ও গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপন করতে চায়।  

আমি এখন সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে হামাস ও নেতানিয়াহু সম্পর্কে কিছু তথ্য জানাব।

এর প্রথমটি ২০০২ সালের। তখনো  ৯/১১–এর কালো ছায়া মুছে যায়নি। ২২ বছর আগের এই সময়টাতে আমি সৌদি আরবে গিয়েছিলাম এবং প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমি জর্জ ডব্লিউ বুশের অনুসরণে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম যে, আরব নেতাদের একটি গঠনমূলক শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। ইসরায়েলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে ইসরায়েলিদের প্রত্যাহার করা হোক ১৯৬৭ সালের সীমারেখা অনুযায়ী।

সৌদি আরবে সপ্তাহখানেক থাকার পর আবদুল্লাহ আমাকে রিয়াদের বাইরে তাঁর ঘোড়ার খামারে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি যাঁর আতিথ্যে সৌদি সফর করেছিলাম, সেই আদেল আল-জুবেইরও আমার সঙ্গে ছিলেন। সে সময় তিনি ওয়াশিংটনে সৌদি দূতাবাসের মুখপাত্র ছিলেন, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। খামারে রাতের ভোজসভায় হাজির ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য ও ব্যবসায়ীরা। ভূরিভোজের পর মধ্যরাতের দিকে আবদুল্লাহ আমাকে তাঁর পড়ার ঘরে ডেকে নিলেন।

আমি আবদুল্লাহর কাছে আমার সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিবন্ধটির কথা পাড়লাম। তাঁকে বললাম, ফিলিস্তিন থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে আরব লিগ ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ একটা শান্তিচুক্তিতে যেতে পারে। তিনি মুখ বাঁকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার ডেস্ক থেকে চুরি করেছ নাকি কিছু? কিছুটা হকচকিত হয়ে আমি বললাম, না।

ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার একটি এলাকা

আবদুল্লাহ পরে বলেন, ‘যে কারণে আমি জিজ্ঞেস করছি...আমি ঠিক এমনটাই ভেবেছি। জেরুজালেমসহ অধিকৃত অঞ্চল থেকে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরোপুরিভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে। এই লাইনে আমি একটা বক্তৃতার খসড়াও তৈরি করে রেখেছি। আমার ইচ্ছে ছিল আরব সামিটে এই বক্তৃতাটা দেব এবং গোটা আরব বিশ্বে জনমত সৃষ্টি করব। কিন্তু আমি আমার মত পরিবর্তন করেছি। কারণ, হঠাৎ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন পশ্চিম তীরে অভিযান চালাতে শুরু করেছেন।’

আমরা রাত তিনটা পর্যন্ত এই নিয়ে আলোচনা করলাম। এরপর বললাম, ‘মাননীয়, আপনার উচিত এই ভাবনা ডেস্কে না রেখে জনগণকে জানানো।’

তিনি আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অনেক বাদানুবাদের পর তিনি ভেবে দেখবেন বলে সম্মতি দিলেন। অবশেষে আমাকে তিনি সাক্ষাৎকারও দিলেন।

আমি জানতাম, এই সাক্ষাৎকারটার উদ্দেশ্য ৯/১১ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরানো। কারণ, ৯/১১–এর ১৯ ছিনতাইকারীর ১৫ জনই ছিলেন সৌদি আরবের। ওই রোববারে আমরা একটা কলাম ছাপলাম, ‘অ্যান ইনট্রিগিং সিগন্যাল ফ্রম দ্য সৌদি ক্রাউন প্রিন্স’।

কলামটি প্রকাশের পর আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মাথায় একরকম আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। আরব নেতারা দ্রুতই এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে বৈরুতে আরব লিগের সম্মেলনে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।

২৭ ও ২৮ মার্চ সব আরব নেতা লেবাননের রাজধানীতে উপস্থিত হন। আবদুল্লাহর সুপারিশে ভর করে তাঁরা আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা করেন, যেমন শরণার্থী প্রত্যাবাসন। ২৮ মার্চ তাঁরা আরব শান্তি উদ্যোগ চূড়ান্ত করেন। ওই উদ্যোগের সারকথা ছিল ৪ জুন, ১৯৬৭ সালের নিয়ন্ত্রণরেখা অনুযায়ী ফিলিস্তিনি অঞ্চল থেকে ইসরায়েলিদের প্রত্যাহারের বিনিময়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে।

আরব লিগের অনুমোদনে এটাই সিরিয়াসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর দিক থেকে প্রথম ও বিস্তারিত শান্তি উদ্যোগ।

আমি সত্যিই ভেবেছিলাম, সংঘাতের সমাপ্তির সূত্রপাত হলো। কিন্তু এই পরিকল্পনা একটুও এগোল না। ইসরায়েলি বা বুশ প্রশাসন কেউই সুযোগটা নিল না। ইসরায়েলিরা কেন ঝাঁপিয়ে পড়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করল না?

আরব লিগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই ইসরায়েল অনেক উদ্যোগ নিতে পারত। কিন্তু কী ঘটল, তার বিবরণ পাওয়া যায় সে রাতে সিএনএনের খবরে।

‘নেতানইয়া, ইসরায়েল—আত্মঘাতী বোমা হামলায় বুধবার সমুদ্রতীরবর্তী একটি হোটেলে ১৯ জন নিহত ও ১৭২ জন আহত হয়েছেন। আজ ছিল ইহুদিদের ধর্মীয় ছুটি পাসওভারের প্রথম দিন। আহত ব্যক্তিদের ৪৮ জন গুরুতর আহত। পার্ক হোটেলের ব্যস্ত ডাইনিং হলে চালানো এই হামলার দায় স্বীকার করেছে হামাস। যুক্তরাষ্ট্রের তালিকায় ইসলামি চরমপন্থী এই দলটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত।’

এভাবেই আরব শান্তিচুক্তির জবাব দিয়েছিল হামাস। ইসরায়েল হামাসের হামলার জবাব দেয় ইয়াসির আরাফাতকে রামাল্লায় আটকে রেখে। এরপর পরিস্থিতির কেবল অবনতিই হয়েছে। হামাস কখনই সমস্যার সমাধান চায়নি।

আমার হামাসকে বরাবর ফিলিস্তিনিদের শত্রু মনে হয়। ইসরায়েলের মতোই হামাসও তাদের আরেক শত্রু। হামাস গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছে, তার পেছনে শান্তি প্রতিষ্ঠার আর কোনো উপায় নেই, এই যুক্তি কাজ করেনি। বরং এটা ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস পরিকল্পনার প্রথম কিস্তি।

হামাস এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কারণ গত দেড় দশকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করতে যা কিছু করা প্রয়োজন, তার সবটাই করেছেন নেতানিয়াহু। অসলো চুক্তির শর্ত হিসেবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের উদ্ভব ঘটেছিল। তারা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে পরিচালনা করে থাকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, নেতানিয়াহু ইচ্ছে করে হামাসকে শক্তিশালী করেছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। নেতানিয়াহু ও হামাসের অভিন্ন উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করা এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে পৌঁছাতে না পারা।

ইসরায়েলি বামপন্থী পত্রিকা হারেৎজ–এর সম্পাদক আলাফ বেন সম্প্রতি তাঁর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের লেখায় দুই অনুচ্ছেদে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ২০০৯ সালে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় ফেরার পর এই যুক্তি দেখাতে শুরু করলেন যে, ফিলিস্তিন ইস্যুকে বাদ দিয়েই ইসরায়েলের পক্ষে পশ্চিমা স্টাইলের রাষ্ট্রগঠন, এমনকি আরব বিশ্বের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। মোদ্দা কথা হলো তাঁর কৌশল ছিল ‘ভাগ করো, শাসন করো’। পশ্চিম তীরে নিরাপত্তা ইস্যুতে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের একরকম যোগাযোগ ছিল। বলতে গেলে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হলো পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের পুলিশিং ও সামাজিক কাজের উপঠিকাদার। নেতানিয়াহু কাতারকে উৎসাহ দিয়েছেন গাজায় হামাস সরকারকে তহবিল দিতে।

এরপর বেন আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। নেতানিয়াহু ২০১৯ সালে সংসদীয় ককাসের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, এটা তাঁর কৌশল। ওই বৈঠকে তিনি আরও বলেন, ‘যারাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চান না, তাদেরই উচিত হবে গাজায় তহবিল সরবরাহে সমর্থন করা। গাজা ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যত দূরত্ব বাড়ানো সম্ভব হবে, ততই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কমবে।’

দুই রাষ্ট্র গঠন নিয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থানকে অত্যন্ত নেতিবাচক চোখে দেখার জন্য আমাকে আপনারা ক্ষমা করুন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গাজা যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, হামাস ও নেতানিয়াহু পুরো সমাজকে ততটাই দূষিত করে তুলবে। ফিলিস্তিন ও পশ্চিমে তাঁদের সমর্থকেরা এখন এ ব্যাপারে একমত যে, পুরো ইসরায়েলই আসলে ঔপনিবেশিক শক্তি এবং নদী থেকে সাগর পর্যন্ত দেশটিকে ধ্বংস করে দেওয়া উচিত। অন্যদিকে ইসরায়েলিরাও এখন তাদের সীমান্তে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করতে পারছে না।

গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে বাড়াবাড়ি হয়েছে এবং এটা বন্ধ করতে হবে বলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে খেদোক্তি করেছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি যখন বাইডেনকে এ কথা বলতে শুনি, আমার মনে হলো তিনি প্রেসিডেন্টের মতো নয় বরং কলাম লেখকদের মতো কথা বলছেন। আরও মনে হলো তিনি এ ঘটনায় একজন পর্যবেক্ষকমাত্র, কোনো কিছু পরিবর্তনের ক্ষমতা তাঁর নেই।  

আমরা তাঁর এই অবস্থানকে মেনে নিতে পারি না। আমার মতে, মাত্র দুজন নেতা আছেন, যাঁরা এই পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। তাঁদের একজন হলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।  

তাঁদের দুজনের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, আপনার পূর্বসূরিরা যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা শেষ করুন।

এমবিএস, আপনি যদি নেতানিয়াহু ও হামাসকে পরাজিত করতে চান, তাহলে আপনার চাচা আবদুল্লাহ ঠিক যে জায়গায় গিয়ে থেমেছেন, সেখান থেকে শুরু করুন। আপনি ঘোষণা দিন যে জেরুজালেম সফর করবেন। প্রথমে আল–আকসা মসজিদে নামাজ পড়ুন, এরপর কেনেসেটের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। তাদের দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে বলুন। আরও বলুন, পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে সৌদি আরবে তখনই স্বীকৃতি দেবে, যখন ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে তারা পূর্ব জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেবে। কেবল তখনই সৌদি আরব আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে।

১৯৭৯ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদত এমনই এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর এই পদক্ষেপের কারণে ইতিহাস তাঁকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এমবিএস, আপনি যদি জেরুজালেমে যান, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি নিরাপত্তার ইস্যুটি সহজেই কংগ্রেসে গৃহীত হতে পারে। এর ভিত্তিতে ইরান ও ইরানের নেতৃত্বে ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননের মতো ব্যর্থ ও প্রক্সি রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে আপনি একটি আঞ্চলিক জোট গঠন করতে পারবেন।  

বিল ক্লিনটন যে অবস্থায় এই ইস্যুকে রেখে গেছেন, জো বাইডেনের উচিত সেখান থেকে শুরু করা।

২৩ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ‘ক্লিনটন মানদণ্ড’ নামে এক ঝুড়ি সুপারিশ উপস্থাপন করেছিলেন। কী করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধের সমাপ্তি ঘটবে, তার উল্লেখ আছে সেখানে। তিনি দুই জাতির জন্য দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্লিনটন তাঁর কাজ শেষ করে যেতে পারেননি, যত দূর পেরেছেন, তত দূর পর্যন্ত করেছেন।

জো, আপনার দায়িত্ব এখন দুই জাতির জন্য দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেওয়া। সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বকে জানান দিন যে আমেরিকা সত্যিকারভাবেই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান চায়। যেহেতু নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় যাবেন না, আপনি নিজেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিন।

ইসরায়েলের একজন জ্যেষ্ঠ শান্তি কর্মী গিডি গ্রিনস্টেইন,  (ইন) সাইটস: পিস মেকিং ইন দ্য অসলো প্রসেস থার্টি ইয়ারস অ্যান্ড কাউন্টিং’ নামে একটি গ্রন্থের লেখক।

কিছুদিন আগে দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত করা হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কের যে অবনতি, তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে। এই দুই রাষ্ট্রের মানুষ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।’

তাহলে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই শেষ করি। আমি ইসরায়েলিদের সঙ্গে একমত। প্রতিদিনই হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে তারা। তারা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে যেতে চায় না। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কোনোভাবেই হামাস ৭ অক্টোবর যা করেছে তার পুরস্কার নয়। আর কখনো যেন এমন না ঘটে, সে কারণেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় প্রয়োজন।

আর গাজা এখন সংঘাতে জর্জর, পশ্চিম তীরে উত্তুঙ্গ ক্ষোভ। আমি জানি, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এখন সংবিধান প্রণয়নের আয়োজন করা সম্ভব নয়। কিন্তু রামাল্লার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারে। তারা যে শান্তি আলোচনার একটি সক্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার, সেই প্রমাণ তাদের রাখতে হবে। এর ফল হবে অভূতপূর্ব। গাজায় অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হলে অসলো চুক্তির ব্যর্থতার পর এবারই সর্বোত্তম সুযোগ পাওয়া যাবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থার।    

বলা যায় না, হয়তো এটিই সর্বশেষ সুযোগ।

  • থমাস এল ফ্রিডম্যান পুলিৎজার বিজয়ী সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গ্রন্থকার।
    নিবন্ধটি নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম