কয়েক দিন আগে প্রথম আলোয় দুই পর্বে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ প্রমাণনির্ভর কুম্ভিলকবৃত্তি প্রকাশের পরও সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যত কোনো জবাবদিহি চোখে পড়েনি। এমনকি যাঁরা বইটি লেখা ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকেও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
যদিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখার পরপরই একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত সংশোধনী দেওয়ার কথা বলেছে, তবে সেই সংশোধনী কোন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে দেওয়া হবে, সেই তথ্য দেওয়া হয়নি, এমনকি উপযুক্ত পর্যালোচনার কথা বলে পাঠ্যপুস্তকের ভুলগুলো স্বীকারও করা হয়নি। বরং কৌশলে ‘যৌক্তিকভাবে’ মূল্যায়ন করে সংশোধনী দেওয়ার কথার মধ্য দিয়ে একধরনের ‘কৈফিয়তহীনতার সংস্কৃতির’ চর্চা করেছে এনসিটিবি।
ফলে যারা এই পাঠ্যপুস্তকটি পড়বে, যাঁরা পড়াবেন, তাঁদের মনে একধরনের ‘খারাপ লাগা’ থেকেই গেল। প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের পাঠ্যপুস্তক অন্যের লেখা চুরি করে লিখতে হবে? কেন যান্ত্রিক অনুবাদে ভুলভাল ইংরেজি বই রচনা করা হবে? কেন প্রতিবছর সংশোধনী দেওয়ার প্রয়োজন হবে? রাষ্ট্রের টাকা গচ্চা দিয়ে এসব সংশোধনী দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখার উদাসীনতা স্পষ্টতর। রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করে যাঁরা কোমলমতি বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নয়ছয় করলেন, তাঁদেরকে জবাবদিহির আওতায় না আনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির ব্যর্থতার পরিচয় বটে।
চীনের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বছর দুয়েক আগে সেই দেশে প্রাথমিক স্তরের চতুর্থ শ্রেণির গণিত বইয়ের একটি চিত্রে বাচ্চার আইব্রো আঁকতে ভুল করেছিল, সেই ভুলের খেসারত হিসেবে সেই দেশের সরকার বইটির প্রধান সম্পাদককে ওই পদ থেকে শুধু অব্যাহতি দেয়নি, চিত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২৭ সদস্যকে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিল। অথচ আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকে ভুল, কুম্ভিলকবৃত্তির মতো ঘটনা কত সহজেই মেনে নেওয়া হয়। শুধু চীন নয়, এর আগে মেক্সিকো ও ফিলিপাইনে পাঠ্যপুস্তকে ভুলভ্রান্তির কারণে পুস্তক–সংশ্লিষ্টদের শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা কি আদৌ আছে?
১৯৮৩ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত গেজেটে সংশোধিত ও পরিমার্জিত যে অধ্যাদেশ সরকার জারি করেছে, সেখানে যে ২৩টি ধারা সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও পাঠ্যপুস্তকে কুম্ভিলকবৃত্তিতে শাস্তির বিধান রাখা হয়নি।
তবে ১৭ ধারায় প্রকাশকদের কাছ থেকে তথ্য, প্রতিবেদন ইত্যাদির ১–এর উপধারায় বলা হচ্ছে, বোর্ড যেকোনো পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণকারী, প্রকাশক, সরবরাহকারী, পাইকারি বিক্রেতা অথবা খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তকের যেকোনো তথ্য, বিবরণী যাচাই করতে পারে।
সাধারণ মানুষ পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরকারের খর্বাকৃতি চেহারা দেখতে চায় না, আমরাও চাই না। প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করে লেখকদের, এনসিটিবিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হোক, সেটি সত্যিই আমরা মনেপ্রাণে চাই না। যেটুকু চাই, তা হলো একটি মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক বাচ্চারা পাক, যা পড়ে তারা বিশ্বমঞ্চের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে, দেশটাকে এগিয়ে নেবে।
এই ধারারই ২ উপধারায় বলা হচ্ছে ‘যদি ১ উপধারার অধীন যাচিত কোনো তথ্য, বিবরণী অথবা প্রতিবেদন সরবরাহে ব্যর্থ হন অথবা এরূপ কোনো তথ্য, বিবরণী বা প্রতিবেদন সরবরাহ করেন, যাহার বিশেষ কোনো উপাদান অসত্য এবং যাহা তিনি অসত্য বলিয়া জানেন বা যুক্তিসংগত কারণে বিশ্বাস করেন, অথবা সত্য নহে মর্মে বিশ্বাস করেন না, তাহলে এই আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
আমরা জানি না, এই ধারা পাঠ্যপুস্তক রচনাকারীদের ক্ষেত্রে সক্রিয় হবে কি না, তবে পাঠ্যপুস্তকের এ ধরনের কুম্ভিলকবৃত্তি যে বড় ধরনের অপরাধ, তার বোধগম্যতা আমাদের থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাঠ্যপুস্তকের তথ্যই সারা বিশ্বে নিরেট তথ্যের উৎস হিসেবে ধরা হয়। পাঠ্যপুস্তকে এমন কোনো ভুলভ্রান্তি থাকা উচিত হবে না, যা পড়ে একটি হাজার হাজার বাচ্চা ভুল জানবে। তাই যেকোনো দেশেই পাঠ্যপুস্তক লেখার ও যাচাই করার একটি বড় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে, সেই ধরনের সুযোগ বা সুবিধা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখার ফলে, তাঁদের ভুলভ্রান্তি কিংবা অপকর্মের শাস্তির বিধান করতে পারছে না। ফলে প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তকের ভুল, চুরি, গুগল ট্রান্সলেটরের ব্যবহার হামেশাই চোখে পড়ার পরও চোখ ঢাকার চেষ্টা করছে। ফলে মানহীন পাঠ্যপুস্তক তৈরির সুযোগ হচ্ছে। আর এভাবে পাঠ্যপুস্তকের গ্রহণযোগ্যতা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে হারাচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইট খুঁজে কোথাও পেলাম না যে পাঠ্যপুস্তক কোন প্রক্রিয়ায় লেখালেখি, মূল্যায়ন করা হয়। তবে সেই মূল্যায়নে যে বড় ধরনের গলদ আছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। তাদের সেই কাঠামোকে পুনর্মূল্যায়ন যে জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এনসিটিবির কাঁধে এসব বিতর্ক নিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি বাচ্চার জন্য পাঠ্যপুস্তক তৈরি হচ্ছে, তবু তাদের ঘুম ভাঙছে না।
সরকারের উচিত হবে পাঠ্যপুস্তকের এই খাতটিকে সত্যিই গুরুত্ব দেওয়া। তাড়াহুড়া নয়, শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তক শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া। শুরুতেই যদি পাঠ্যপুস্তকের নৈতিকতা ভেঙে পড়ে, তাহলে কিনারায় পৌঁছাবে কী করে?
সাধারণ মানুষ পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরকারের খর্বাকৃতি চেহারা দেখতে চায় না, আমরাও চাই না। প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করে লেখকদের, এনসিটিবিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হোক, সেটি সত্যিই আমরা মনেপ্রাণে চাই না। যেটুকু চাই, তা হলো একটি মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক বাচ্চারা পাক, যা পড়ে তারা বিশ্বমঞ্চের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে, দেশটাকে এগিয়ে নেবে।
● ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
nadim.ru@gmail.com