সাম্প্রদায়িক উসকানি নস্যাৎ হলে কার ক্ষতি

শ্রীমঙ্গলবাসী গোটা দেশবাসীর সহযোগিতায় ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে যেভাবে সাম্প্রদায়িক হামলার উসকানি প্রতিরোধ করলেন, তখন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রীতম দাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কী বার্তা গেল?
ছবি : প্রথম আলো

ডাক্তার আসিবার আগেই রোগী মারা গেল মানে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শাহবাগে কিংবা প্রেসক্লাবে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার যে ধরন, সেটি করেননি শ্রীমঙ্গলবাসী। গত ২ সেপ্টেম্বর  জুমার নামাজের আগেই মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ শ্রীমঙ্গলের ধর্মপ্রাণ মানুষ বিষয়টাকে সামাল দিয়েছেন।

যা নিয়ে ঘটনার কয়দিন পর প্রথম আলোতে লিখলাম ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি: শ্রীমঙ্গল যেভাবে প্রতিরোধের পথ দেখাল।’ ঘটনা ছিল ২০২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ মসজিদ থেকে কোনো মিছিল ছিল না। উসকানিটা শ্রীমঙ্গলের জনগণ ঠেকিয়ে দিয়েছেন। মীমাংসা করেছেন স্থানীয়ভাবেই।

তবে এক সপ্তাহ পর শুক্রবার বিকেলে কেন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেপ্তার হলেন প্রীতম দাশ? জনগণ যা মীমাংসা করলেন, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেন পছন্দ হলো না? স্থানীয় পুলিশের তাহলে কী পছন্দ? জাগো নিউজের কলাম ‘নও পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ’–এ মান্টোর গল্পটি যিনি তুলে এনেছেন, তিনি ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। আর প্রীতম দাশ মাত্র সেখান থেকে কপি করে দোষী হয়ে গেলেন?

অথচ শ্রীমঙ্গলবাসী গোটা দেশবাসীর সহযোগিতায় ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে যেভাবে সাম্প্রদায়িক হামলার উসকানি প্রতিরোধ করলেন, সবকিছু স্বাভাবিক হলো, তা সারা দেশের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল, তখন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রীতম দাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কী বার্তা গেল?

২.

গত ১২ আগস্ট প্রথম আলোতে বদরুদ্দীন উমর ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কারা হামলা করে’ শিরোনামে লিখেছেন, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রকৃত কোনো সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেই। এই আক্রমণ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কিত ও সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৭২ সাল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, বর্তমানের হামলা ও আক্রমণ তারই ধারাবাহিকতা।

নড়াইলের সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে বিবিসিতে সেখানকার সাবেক ইউপি সদস্য বিউটি রাণী মণ্ডল বলেছেন, ‘যেখানে তাঁরা যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করছেন, সেখানে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে না।’

ভোলার সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ জন নিহত হওয়া নিয়ে ‘বোরহানউদ্দিনে হামলাকারীদের চেনে না কেউ, গা–ছাড়া প্রশাসন’ শিরোনামে ভোরের কাগজে সরেজমিন প্রতিবেদন করেন সেবিকা দেবনাথ ও এইচ এম নাহিদ। বাংলা ট্রিবিউন ১৪ অক্টোবর শিরোনাম করে: ‘ফেসবুকের “ভুয়া খবরেই” দেশের সব সাম্প্রদায়িক হামলা।’
শ্রীমঙ্গলের জনসংখ্যায় হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান যেমন আছে, তেমনি বাঙালি ও অন্যান্য জাতির মানুষও আছে। ফলে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বোঝাপড়াও ভালো।

চা–শ্রমিকেরা ভালো থাকলে খুদে ব্যবসায়ীরাও ভালো থাকেন। তাই প্রীতম দাশরা যখন চা–শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে ছিলেন, তখন গোটা শ্রীমঙ্গলবাসীই আসলে তাঁদের পেছনে ছিলেন। কিন্তু প্রশাসন ও সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কয়েকজনের তা মনঃপূত হলো না। মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রীতম দাশের গ্রেপ্তার তারই ফল। ডেইলি স্টার শিরোনাম করেছে: ‘প্রীতমের পুরোনো পোস্ট চা–শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় ভাইরাল করে ছাত্রলীগ।’ আর নিউজ বাংলা টোয়েন্টিফোর জানিয়েছে: ছাত্রলীগ কর্মীর ‘ধর্ম অবমাননার’ মামলায় সেই প্রীতম দাশ গ্রেপ্তার।

অথচ শ্রীমঙ্গলবাসী গোটা দেশবাসীর সহযোগিতায় ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে যেভাবে সাম্প্রদায়িক হামলার উসকানি প্রতিরোধ করলেন, সবকিছু স্বাভাবিক হলো, তা সারা দেশের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল, তখন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রীতম দাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কী বার্তা গেল?

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের বরাতে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, ‘প্রীতম দাশের বিরুদ্ধে মামলাকারী মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ছাত্রলীগ।’ কিন্তু প্রীতম এখনও কারাগারে। মামলা তোলার কী হবে? স্থানীয় জনগণের কাছেও আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক সংগঠনের পরিচিতি দাঁড় হলো। এ ক্ষতি কার হলো?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সাম্প্রদায়িক উসকানিকে জনগণ নস্যাৎ করে দিলে সরকারের কষ্ট হয়। শ্রীমঙ্গলে প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে তা আবার স্পষ্ট হলো।

৩.

বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। ওই ঘটনায় ভারতের প্রায় সব জায়গাতে দাঙ্গা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন তখন তাদের ক্ষমতা আর দৃঢ়তা দেখিয়েছিল।

সেই সময়ে একটা সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত উর্দু কবি জাভেদ আখতার জ্যোতি বসুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা হয়নি কেন?

তখন তিনি এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, কিউ কি হুকুমত নেহি চাহতি। অর্থাৎ প্রশাসন চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না।

কিন্তু বাংলাদেশে চায় কেন? দার্শনিকেরা বলছেন, চায়। কারণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক বোঝাপড়া, যৌথতা, জনগণের ঐক্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা আর গণতন্ত্রের মৃত্যু উদ্‌যাপনের বড় বাধা।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge@gmail.com