বেইলি রোডের ভবনটিতে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগে
বেইলি রোডের ভবনটিতে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগে

মতামত

ফায়ার সার্ভিসের আশায় বসে থাকা ছাড়া কি কিছু করার নেই

২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লেগে এ পর্যন্ত ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, তা গ্যাসের চুলা আর রান্নাঘরের আধিক্যে ছিল একটি সম্ভাব্য দাহ্যক্ষেত্র। মালিকসহ দায়িত্বশীলেরা সবাই উদাসীন ছিলেন। দরজা খুলে ঘুমালে তার পরিণতি যা হওয়ার কথা, তা–ই হয়েছে। 

মনে পড়ছে, ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুন লেগে ১২৪ জনের মৃত্যু, ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৭৮ জনের মৃত্যু, একই বছরে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালে মগবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণে ১১ জনের মৃত্যু, একই বছরে রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে অর্ধশতাধিক মৃত্যু, ২০২২ সালে সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মৃত্যু, ২০২৩ সালে সিদ্দিক বাজারে গ্যাস বিস্ফোরণে ২২ জনের মৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনাগুলো।  

আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ফেলার মতো যে আয়োজন থাকতে হয়, তা কোথাও তেমন একটা চোখে পড়ে না।

মনে হয় সবাই মনে করে, আগুন লাগলে নির্ধারিত নম্বরে ডায়াল করে ফায়ার সার্ভিসে খবর দিতে হবে। নিজেরা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না তা ঠিক।

এই নিবন্ধকার বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর কয়েকটি গিজগিজ করা মার্কেটের বিক্রয়কর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন, তাঁরা আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) দিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম কি না। বেশির ভাগই নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে কি না এবং তা কেমন করে চালাতে হয়, তা-ও জানেন না। 

রাজধানীতে অনেকগুলো মার্কেট আছে, যা এত কাছাকাছি যে মাঝ দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটা যায় না। এসব মার্কেটে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত আছে? ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসতে আসতে বিক্রয়কর্মীরা যাতে দ্রুত আগুন নেভাতে পারেন, সে জন্য চার-পাঁচটি দোকান পরপর একটা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে কি না?

এ ক্ষেত্রে বিক্রয়কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়োগদাতারা করেন কি না? এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র চালাতে পারেন কি না, নিয়োগের সময় এ বিষয়টি জিজ্ঞাসা করা হয় কি না? 

প্রতিটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে একটি ছোট আকারের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (টিনের তৈরি বোতল সিলিন্ডার) থাকা একান্ত দরকার। এসব সাধারণত সাদা পাউডারের মতো কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্বারা পূর্ণ থাকে। রান্নাঘরের চুলায় আগুন লেগে গেলে এসব ছোট যন্ত্রের সাহায্যে আগুন সহজেই নিভিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু রেস্তোরাঁগুলোর রান্নাঘরে কি এমন যন্ত্র দেখা যায়? 

মার্কেটগুলোয় কি বছরে এক-দুবার বিক্রয়কর্মীদের নিয়ে আগুন নেভানোর মহড়া করা হয়? এই নিবন্ধকার জাপানের টোকিওতে গবেষণাগারে কাজ করার সময় বছরে দুবার আগুন নেভানোর মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছেন, যা ছিল বাধ্যতামূলক। নতুন যোগদান করা লোকদের নিজ হাতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভাতে হতো। মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকা এবং সেগুলো বিক্রয়কর্মীরা বাধ্যতামূলকভাবে চালাতে জানতে হবে।

দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মীদের তো তা জানতেই হবে, যেহেতু তাঁরা রাত্রিকালীন পাহারা দেন। আগুনের সূত্রপাত দেখলেই প্রাথমিকভাবে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তাহলে আর বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটে না। প্রতিটি মার্কেটের কমিটিগুলোই কাজটি দায়িত্ব নিয়ে করতে পারে।

মার্কেট বা বাসাবাড়িতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ও মহড়া যদি নিজেদের উদ্যোগে না করা হয়, তবে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা যে আরও ঘটবে না, সেটা কেউ বলতে পারে না। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নিজেদের আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না থাকার অর্থ দরজা খোলা রেখে ঘুমানোর মতোই। ফলে সেখানে যেকোনো অঘটন ঘটে যাওয়াই স্বাভাবিক।

রাজধানীতে কয়েক লাখ অ্যাপার্টমেন্ট ভবন আছে। ভবনগুলোর প্রতিটি তলায়, ছাদে, গ্রাউন্ড ফ্লোর, কার পার্কিংয়ে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকতেই হবে। এসব যন্ত্রের মেয়াদ থাকে সাধারণত দুই বছর। দুই বছর পরপর যখন রিফিল করতে হয়, তখন রিফিল করার আগে সেগুলো দিয়ে ভবনের বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে একটি ফায়ার ড্রিল বা মহড়া করা যায় প্রায় বিনা খরচেই। 

বঙ্গবাজারে আগুন নেভানোর চেষ্টায় তখন কীভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে হাতিরঝিল থেকে পানি আনতে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। তা কতটা কার্যকর ছিল, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও ফায়ার সার্ভিস যে পানির অভাবে অসহায় ছিল, তা ছিল স্পষ্ট।

যেকোনো জায়গায় স্থাপনা করতে হলে পানির আধার ও অগ্নিনির্গমন পথের কথা প্রথমেই ভাবতে হবে। তা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য। আগের দিনের ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো সারা শহরে কেন নেই, তা বোধগম্য নয়। 

মার্কেট বা বাসাবাড়িতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ও মহড়া যদি নিজেদের উদ্যোগে না করা হয়, তবে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা যে আরও ঘটবে না, সেটা কেউ বলতে পারে না। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নিজেদের আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না থাকার অর্থ দরজা খোলা রেখে ঘুমানোর মতোই। ফলে সেখানে যেকোনো অঘটন ঘটে যাওয়াই স্বাভাবিক।

ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ