‘উপসংস্কৃতি’ বা ‘সাবকালচার’ শুধু বাংলাদেশেই জন্মাচ্ছে না, দুনিয়াজুড়েই খই-মুড়ি-মুড়কির মতো জন্মাচ্ছে। বাংলাদেশে জন্মাচ্ছে ওয়াজ সাবকালচার, মোটিভেশনাল স্পিচ সাবকালচার, বিসিএস সাবকালচার, রাঁধারাঁধি-ঘোরাঘুরি সাবকালচার, টিকটকার সাবকালচার, দালাল সাবকালচার, ব্যাংক লুট ও টাকা পাচার সাবকালচার, গ্যাং সাবকালচার এবং আরও নানা সাবকালচার। এগুলোর মধ্যে তর্ক-কুতর্কে চলে এসেছে হিরো আলম সাবকালচার। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে ‘সাবকালচার’ বা ‘উপসংস্কৃতি’ সমাজ পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় খুবই কার্যকর একটি ধারণা।
তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্য একটি ধারণা দেওয়া যাক। ‘উপ’ উপসর্গটি দিয়েই বোঝা যায় ‘উপসংস্কৃতি’ মূলধারার সংস্কৃতি নয়, তবে উপজাত। যেমন অপরিশোধিত পেট্রল পরিশোধনের সময় প্লাস্টিক, রং, নাইলন ইত্যাদি তৈরি হয়। যেমন গ্যাং সাবকালচার বা আন্ডারগ্রাউন্ড সাবকালচার তৈরি হয় দুর্নীতির সংস্কৃতির উপজাত হিসেবে। ড্রাগ সাবকালচার তৈরি হয় আইন ও শৃঙ্খলা সংস্কৃতির অধঃপতনের উপজাত হিসেবে।
উপসংস্কৃতির গ্যাং ও ড্রাগ উদাহরণ দুটি টানার কারণে ‘উপসংস্কৃতি’ মানেই খারাপ কিছু মনে করার কোনোই কারণ নেই। অসংখ্য নির্দোষ ও স্বাভাবিক উপসংস্কৃতিও জন্ম নিতে পারে। মাঝেমধ্যেই সমাজে বিনির্মাণ (ডিকনস্ট্রাকশন) জরুরি হয়ে পড়ে। সমাজের অনেক মানুষ যখন কোনো কিছুকে বড়সড় ধাক্কা দিতে চান, ভাঙন চান, চ্যালেঞ্জ চান, সমাজবদল দরকার মনে করেন, রাগ-ক্ষোভ-বঞ্চনার চাপা যন্ত্রণা উগরে দেওয়ার উপায় খোঁজেন, তখন অপ্রথাগত ও উল্টো স্রোতে চলার মধ্যেই উপায় খোঁজে। পাশ্চাত্যে হিপ্পি, পাংক সাবকালচার জন্ম নিয়েছিল সোভিয়েত-মার্কিন শীতল যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিতে কাটছাঁট, করপোরেশনের একাধিপত্য, পুঁজির দাপট, মানুষে-মানুষে বৈষম্য বাড়া ইত্যাদির প্রতি তীব্র ঘৃণা হিসেবে। সাব
আশির দশকে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা পথনাটক, গ্রাম থিয়েটার, পল্লিনাট্য ইত্যাদি দিয়ে হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছিলেন। মজলুম, আমজনতা ও নিম্নবর্গের মানুষদের তাতে সম্পৃক্ততা ছিল। তাঁরা সংস্কৃতিকর্মীদের নিজেদের লোক, ভাই-বন্ধু, গৃহসদস্য মনে করতেন। ভাবতেন, তাঁদের হয়ে কথা বলার যোগ্য লোকের অভাব নেই। তারপর তাঁরা দেখলেন, বিপ্লবী সংস্কৃতিকর্মীরা বা নিম্নবর্গের হয়ে কথা বলার ‘সুযোগ্য লোকগণ’ মাঠ ছেড়ে ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকে গেলেন।
কালচারগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলোই ছিল দৃষ্টিকটু রকমের দৃষ্টিকাড়া উদ্ভট পোশাক-আশাক। শুধু প্রাচ্যের মধ্যবিত্তরাই হিপ্পি বা পাংকদের সাবকালচারকে রুচিহীন ও বিসদৃশ মনে করত না; বরং খোদ পাশ্চাত্যের মধ্যবিত্তের এলিট অংশও রুচির প্রশ্ন তুলেছিল। অনেক পরে অবশ্য প্রায় সবাই উপসংস্কৃতিগুলোর মর্মার্থ ধরতে পেরেছিল।
সাবকালচারগুলোর আয়ু সাধারণত কম। মজা ফুরিয়ে গেলেই শেষ। যেমন হিপি সাবকালচার, পাংক সাবকালচার বা বেল বটম সাবকালচার টেকেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি, বিশ্বায়ন, বৈচিত্র্য ও অংশগ্রহণমূলক কাজে বিদ্বেষ-বর্ণবাদ কমে আসায় সেগুলোর প্রয়োজন থাকেনি। ‘হিরো আলম সাবকালচার’ও হয়তো টিকবে না। তবে আমরা টিকিয়ে রাখলে টিকবে। আমাদের কুতর্ক-কুভাবনার কারণে টিকেও যেতে পারে।
ইন্টারনেট, ইউটিউব, বিশ্বায়ন ইত্যাদির কল্যাণে নানারকম সাবকালচারের জন্ম হওয়া অবধারিত। আপনার আমার পছন্দ হোক বা না হোক—অবধারিত। সাবকালচারগুলো বেআইনি, সমাজবিরোধী বা অপরাধসম্পৃক্ত (যেমন গ্যাং সাবকালচার, অ্যাপভিত্তিক ক্যাসিনো সাবকালচার, সেক্সট্র্যাপ সাবকালচার) না হলে সমস্যার কিছু নেই।
সব প্রতিবাদ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ নয়। সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ প্রথমত রাস্তার মানুষের, নিম্নবর্গের অংশগ্রহণের ও একাত্মতাবোধের। দ্বিতীয়ত, এটি রুচিশীলতা, সুশীলতা, প্রমিতবাদ ধরনের আদুরে আদুরে ভাবনায় সায় তো দেয়ই না, উল্টো চ্যালেঞ্জ ছোড়ে এবং উদ্ভটত্ব দিয়েই প্রতিবাদের জানান দেয়। আবারও হিপি-পাংক সাবকালচারকে মনে করা যাক।
ব্রা বার্নিংয়ের কথাই ধরা যাক। ১৯৬৮ সালের কথা। পশ্চিমা নারীরা রাস্তায় নেমে দলে দলে ব্রা পোড়াচ্ছে। কারণ, ব্রা নারীর বক্ষদেশ সুডৌল রেখে পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজ করে।রূপক হলেও আপাতদৃষ্টে দৃষ্টিকটু ও রুচিহীন কাজের খেতাব পেয়েছিল আন্দোলনটি। নারীদের ব্রা পোড়ানো, হিপি ও পাংকদের উদ্ভটতম পোশাক, উলকি, হাঁটু অবধি চুল বা চালচলন—কোনোটিই কি সুশীল মানদণ্ডে রুচিশীল ছিল? ছিল না। কিন্তু এখন শিক্ষিত শহুরে রুচিশীল সংস্কৃতিমান জনগোষ্ঠীই আন্দোলনটিকে সম্মানের চোখে দেখে। কারণ, উপসংস্কৃতিও সমাজ পরিবর্তনের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। হিরো আলম উপসংস্কৃতিও ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের পুরোধা ব্যক্তিরা তো বটেই, শহুরে শিক্ষিত-মার্জিত ভাবনার মানুষদের কাছেও হিরো আলমের বিনোদন কর্মকাণ্ডগুলো দৃষ্টিকটু, অসংস্কৃত ও অস্বাভাবিক ঠেকতেই পারে। তবে মধ্যবিত্তের হুটহাট রায় দিয়ে ফেলা আরও বেশি দৃষ্টিকটু, কুৎসিত ও অস্বাভাবিক। অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। কাগজের স্থানাভাবে একটি উদাহরণ দিই। টিভি চ্যানেলগুলোতে নাটকের ও বিনোদনের স্রষ্টা কিন্তু শহুরে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক দাবিদারদের কাজ। নাটকগুলোর বড়জোর ৫ শতাংশ নাটক। বাকি ৯৫ শতাংশই অস্বাভাবিক হ্যাংলামো, ছ্যাবলামো, নোংরামো এবং একটি প্রজন্মের বিকৃত আচরণের উপস্থাপনায় ভরপুর। এসব স্থূল বিনোদন একটি বড়সড় দর্শক দল তৈরি করেছে। টিআরপি ও বিজ্ঞাপনের লোভে চ্যানেলগুলো সেগুলো চালায়।
হিরো আলমরা এখানে কোনো বাগড়া দেয়নি, ভাগও বসাতে আসেনি। কিন্তু সংস্কৃতিমনস্কতার ভাবধারী পুরোধা ব্যক্তিরা কখনো প্রতিবাদ করেননি। সংস্কৃতির শহুরে বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। কারণ, তাঁদের অনেকেই চ্যানেলগুলোর মালিক, ক্ষমতাবলয়ের তোয়াজতুষ্টির মাধ্যমে টিআরপি, বিজ্ঞাপন, আয়-রোজগার, সচ্ছলতা—সবই তাঁদের হয়েছে। এই সুবিধাবাদী বা সুবিধাপ্রাপ্ত সাবকালচার যখন একজন সুবিধাবঞ্চিত সাবকালচার বিষয়ে রায় দিয়ে বসে, তখন তাঁদের দ্বিচারিতা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়দের নজর এড়ায় না। তাঁরা সমালোচিত হন।
আশির দশকে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা পথনাটক, গ্রাম থিয়েটার, পল্লিনাট্য ইত্যাদি দিয়ে হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছিলেন। মজলুম, আমজনতা ও নিম্নবর্গের মানুষদের তাতে সম্পৃক্ততা ছিল। তাঁরা সংস্কৃতিকর্মীদের নিজেদের লোক, ভাই-বন্ধু, গৃহসদস্য মনে করতেন। ভাবতেন, তাঁদের হয়ে কথা বলার যোগ্য লোকের অভাব নেই। তারপর তাঁরা দেখলেন, বিপ্লবী সংস্কৃতিকর্মীরা বা নিম্নবর্গের হয়ে কথা বলার ‘সুযোগ্য লোকগণ’ মাঠ ছেড়ে ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকে গেলেন।
শুধুই শিল্পকলা, মহিলা সমিতিতে সেঁটে গেলেন। ‘স্যার’ও এলিট হলেন। এনজিও, করপোরেশন, ব্যাংক-বিমার মালিক বনে গেলেন। প্রাডো-রেঞ্জ রোভারে চড়লেন, ক্ষমতাবলয়ের ধামাধরা হয়ে থাকলেন। হিরো আলমের মতো সামান্য মানুষকেও ভোট কারসাজিতে হারানো হলে তাঁদের মুখে সামান্য নীতি-নৈতিকতার একটি কথাও ওঠে না, বরং অন্যায়ের প্রতি সমর্থনই বজায় রাখেন।
তাহলে তাঁরা কেনই-বা আশা করবেন, তাঁরা জাতে উঠে গিয়ে যে শূন্যস্থান তৈরি করে দিলেন, সেটি শূন্যই থাকতে হবে, কেউ পূরণ করতে পারবে না। পূরণ করলেও তাঁদের রুচির মানদণ্ডেই করতে হবে? কেন আশা করবেন, আম-মানুষ তাঁদের আইডল বা অনুসরণীয় ভেবেই যাবেন? বাস্তবতা হচ্ছে, শূন্যস্থান কখনোই শূন্য থাকে না। সাবকালচার শূন্যস্থানটি দখলে নেবেই। এলিট সংস্কৃতিমনাদের দোষেই হিরো আলম সাবকালচার টিকে থাকবে।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।