মতামত

প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোয় এবং কমে যাওয়ায় কী হয়

ধরা যাক, শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আছে এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

বাস্তবতা হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকার নেই। ৫ আগস্ট সেই ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এরপর দেশের দায়িত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।

এ সরকারের আমলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ।

এর আগের (২০২২-২৩) অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

পরিসংখ্যানগত এ দুই বাস্তবতার কী প্রভাব মানুষের জীবনে পড়ছে। বলা হচ্ছে, পরিসংখ্যানগত সংশোধনের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে।

সেটা না করে যদি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানো হতো, তাহলে কি আমাদের জীবনমানের উন্নতি হতো বা আমরা কি আরও ভালো অবস্থায় থাকতাম।

২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন সময়ের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিল-জুনে কি আমরা বেশি খারাপ ছিলাম? উত্তর, মোটেও না।

অথচ এই সময়ের প্রবৃদ্ধির হারে কী বিশাল তফাত—প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

আগের সরকার প্রবৃদ্ধির বড়াই করত। সেই জামানায় উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি মোটেও টেকসই ছিল না।

বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরও বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ব্যয় গত এক দশকে জিডিপির অনুপাতে ২৩ থেকে ২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিশেষত সরকারি খাতে ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, যার হাত ধরে জিডিপি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।

রাজস্ব আহরণ কমতে কমতে জিডিপির অনুপাতে ৮ শতাংশে নেমেছে। তা সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়েছে।

কিছু মানুষ করে-কেটে খেয়েছে, কিন্তু মানুষের জীবনমানে গুণগত কী প্রভাব পড়েছে, সে প্রশ্ন সুচের মতো নীতিপ্রণেতাদের বিদ্ধ করবে।

সবচেয়ে দৃষ্টিকটু বিষয় ছিল সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচক স্থির থাকলেও প্রবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া কী এক অদৃশ্য কারণে যেন ছুটতই।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অন্যান্য সহগ ও সূচকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। যেমন বেসরকারি বিনিয়োগের কথা বলা যায়, এক দশকের বেশি সময় ধরে এর হার ২৩ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সেই সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ, পুঁজিপণ্যের আমদানি, জ্বালানির ব্যবহার ইত্যাদি সূচকের সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার মেলে না।

প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। কিন্তু শিল্প প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে কৃষিতে। এখনো তা-ই হচ্ছে।

জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও কর্মসংস্থান এখনো বেশি হচ্ছে কৃষিতে। আবার কর্মসংস্থান না বাড়লে শিল্পে বড় ধরনের যান্ত্রিকীকরণ হতে পারে।

তা অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে, কিন্তু এতটা হয়নি যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বদৌলতে কর্মসংস্থানের গতি তার চেয়ে অনেক কম হবে।

দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প খাতের হিস্যা যখন ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, কৃষির অবদান যেখানে ১২-১৩ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে, সেখানে এখনো এই খাতে কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ এই প্রবৃদ্ধির সুফল এখনো মানুষ পাচ্ছে না।

কথা হচ্ছে, এখন যদি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে দেখানো হতো, তাহলেও মানুষের অবস্থার বিশেষ রকমফের হতো না। জিডিপির অনুপাতে কর্মসংস্থান সেই হারে বাড়েনি।

দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তারের কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতের বিকাশ ঘটেছে। ফলে আনুষ্ঠানিক খাতে শোভন কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়েনি।

ঠিক সে কারণেই সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের এত আকর্ষণ এবং তার পরিণতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন;  তার জেরে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন।

জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ভালো থাকার সরাসরি সম্পর্ক যে নেই, বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কম প্রবৃদ্ধির দেশেও মানুষ ভালো থাকতে পারে, যদি সেখানকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা থাকে।

এখানে তো সবকিছু কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। সরকারি পরিসংখ্যানে ৮ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার চুইয়ে পড়া প্রভাবে অনেক মানুষ করে-কেটে খেয়েছে; কিন্তু তা যে টেকসই নয়, করোনা মহামারির সময় তা পরিষ্কার হয়ে গেল।

ওই সময় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা থেকে এখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তখন যেভাবে ঢাকার পথেঘাটে ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা ও রিকশাচালকের সংখ্যা বেড়ে গেল, তার জের এখনো চলছে।

পরিণতিতে পুরো ঢাকা শহর এখন ভ্রাম্যমাণ বাজারে পরিণত হয়েছে। গত জুলাই মাস থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে সেই ধারা এখনো অব্যাহত।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাঠামোগতভাবেই অসমতামূলক, কিন্তু সেখানে প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য থাকলে মানুষের জীবন কিছুটা স্বস্তির হয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোয় মানুষ খারাপ নেই।

রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য থাকায় ওই সব দেশের সরকার যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে যে ক্রোনি বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে মানুষের অনিশ্চয়তা বেড়েছে।

নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনের এই অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বেশি, শিক্ষিত মধ্যবিত্তও তার বাইরে নয়। মানুষের জন্য রাষ্ট্রের যেন কিছুই করণীয় নেই। সবকিছু হাতে গোনা কিছু মানুষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে। রাষ্ট্র তাঁদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছিল।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কমেছে। ফলে সন্তানের মানসম্পন্ন পড়াশোনা ও বৃদ্ধ বয়সে সুস্থ থাকতেই আয়ের বড় একটি অংশ বেরিয়ে যায় বেশির ভাগ মানুষের।

জীবনের শখ-আহ্লাদ ও স্বাচ্ছন্দ্য—এসব বিলাসিতায় পরিণত হয়। অথচ সুস্থ জীবনের যেন এসব অপরিহার্য।

দেশের স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের জাতীয় পেশা এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো। যে দেশ গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেই দেশের জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর হতে পারে না।

এদিকে আমাদের এলডিসি উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। সামনে আমরা অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা হারাব। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে।

কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্যে এ বরাদ্দ নিয়ে আমরা বেশি দূর যেতে পারব না। সে জন্য এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে আমাদের প্রবৃদ্ধির গুণতম মান বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি যাত্রার সূচনা করা।

পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের জনসংখ্যার হিসাবও কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এতে মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো গেছে।

ভারতের চেয়ে আমাদের মাথাপিছু আয় বেশি হয়েছে, যদিও ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি; সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তায়।

পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানোর কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

আবার সেটা নিজেদের জন্যও বুমেরাং হতো; আমরা যে এলডিসি উত্তরণের পরও বাজারসুবিধার দাবি জানাচ্ছিলাম, আমাদের ফোলানো-ফাঁপানো অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

আলোচনার টেবিলে এসব বাধা হয়ে দাঁড়াত। প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশিত হলে বরং আমাদের পক্ষে দর-কষাকষি সহজ হবে। কদর্য বিষয় হলো, পরিসংখ্যান নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সাবেক সরকারের অর্থমন্ত্রীর নিয়েও দ্বন্দ্ব হয়েছে।

এখন যে বাস্তবতা, যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তাতে বিনিয়োগ বাড়বে না। প্রবৃদ্ধির গতিও কমে যাবে। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর সংগ্রহ বাড়িয়ে যদি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে, তাহলে তারা স্মরিত হবে। নির্বাচিত সরকার এলে অনেক কিছুই ফেলে দেবে, আমাদের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে; কিন্তু একচেটিয়াতন্ত্র ভেঙে প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারলে একটা কাজের কাজ হবে। তখন যা খুশি তা-ই করা কঠিন হবে।

বাস্তবতা হলো, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেশি থাকা মন্দ নয়, কিন্তু সমতামূলক না হলে বেশির ভাগ মানুষ তার সুবিধা পায় না।

এখন যে বাস্তবতা, যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তাতে বিনিয়োগ বাড়বে না। প্রবৃদ্ধির গতিও কমে যাবে। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর সংগ্রহ বাড়িয়ে যদি সামাজিক নিরাপত্তা

খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে, তাহলে তারা স্মরিত হবে।

নির্বাচিত সরকার এলে অনেক কিছুই ফেলে দেবে, আমাদের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে; কিন্তু একচেটিয়াতন্ত্র ভেঙে প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারলে একটা কাজের কাজ হবে। তখন যা খুশি তা-ই করা কঠিন হবে।

এর একটি মানদণ্ড হতে পারে এমন—দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো। এতে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়ত; শহরাঞ্চলে অটোরিকশা কমত।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক