‘একতরফা’ নির্বাচন কি রীতি হয়ে গেল?

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল
ছবি: প্রথম আলো

আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় গত ১৬ মার্চ পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান, হাতাহাতি-ধাক্কাধাক্কি, বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ছিল। এর আগের দিন ১৫ মার্চ একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় এবং তার মধ্যেই ভোট গ্রহণ চলে।

এসবের ফলাফল হলো একটি ‘একতরফা’ নির্বাচন। এই নির্বাচনে সব পদে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। কিন্তু নির্বাচনে কি শুধু তাদেরই জয় হয়েছে? এর মাধ্যমে কি ‘একতরফা’ নির্বাচন আরেকবার জয়ী হলো না?

বাংলাদেশে ‘একতরফা’ নির্বাচনের একটি বড় উদাহরণ হলো ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচন বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে সেবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সেই হিসেবে নির্বাচনটা ছিল ‘অংশগ্রহণমূলক’। কিন্তু নির্বাচনী পরিবেশ ও ভোটের ফল ছিল ‘একতরফা’। ক্ষমতাসীন জোটের আসনসংখ্যা ও ভোটপ্রাপ্তির হার এত বেশি ছিল, ভোটের ফল নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের বহু অভিযোগ রয়েছে এবং সেটাকে অনেকেই ‘রাতের ভোট’ বলে অভিহিত করেন। নানা রকম প্রশ্ন ও অভিযোগের মধ্য দিয়েই সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আরেকটি ‘একতরফা’ জয় পায়।

শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক হওয়ার বদলে ‘একতরফা’ হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলমন্ত্র। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার। কিন্তু একের পর এক ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করছে, সেটা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী নয়?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত এ রকম বহু ‘একতরফা’ নির্বাচন হয়েছে। এমনকি পেশাজীবী অনেক সংগঠনেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। এরপরও অনেকের প্রত্যাশা ছিল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। কারণ, এটি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। তাঁরা দলমত-নির্বিশেষে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। তা হলো, নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো জটিলতা তৈরি হলে হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে, বার (আইনজীবী সমিতি) ও বেঞ্চ (আদালত) একটি পাখির দুটি ডানা বা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর হওয়াটা আদালতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের হতাশ করল।

আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে কথা হয়েছিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে। এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেছিলেন, এ রকম নির্বাচন ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, তিনি এর আগে তা দেখেননি। বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভেতরে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনাকে তিনি ‘অভূতপূর্ব’ বলেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। এরপর ওই দিন দুপুরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘…প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি সমিতির বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। …’ (প্রথম আলো, ১৭ মার্চ)। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য অনুসারে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের কোনো কিছু করার নেই। তবে এই কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন। শুক্রবার তাঁকে ফোন করলে তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রধান বিচারপতি এখানে ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ, ঘটনাগুলো সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভেতরেই ঘটেছে। তা ছাড়া এ ঘটনাগুলো সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা রক্ষায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে কয়েকজন ‘নির্দলীয়’ আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। তাঁরা প্রত্যেকেই হতাশা প্রকাশ করলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, সব প্রতিকূলতার মধ্যেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কিন্তু তাঁদের সেই আশা পূর্ণ হয়নি। এক আইনজীবী বন্ধু বললেন, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।’ সত্যিই তো, সারা দেশে যা চলছে, সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতি ভিন্ন প্রত্যাশা থাকলেও তাঁরা এর থেকে দূরে থাকেন কীভাবে?

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এই ‘ভূমিধস’ বিজয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা উচ্ছ্বসিত হতেই পারেন। কিন্তু ‘একতরফা’ এই নির্বাচন কয়েক বছর ধরে দেশে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে চলমান উদ্বেগ-আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার ফলে নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আস্থা-আগ্রহ আরও কমল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখন নির্বাচন হলো ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ধরে রাখা এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীকে যেকোনো উপায়ে জিতিয়ে আনার একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আর এ কারণেই ‘একতরফা’ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক হওয়ার বদলে ‘একতরফা’ হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলমন্ত্র। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার। কিন্তু একের পর এক ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করছে, সেটা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী নয়?

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক