যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর ফ্লোরিডায় ট্রাম্প সমর্থকদের উল্লাস
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর ফ্লোরিডায় ট্রাম্প সমর্থকদের উল্লাস

বিশ্লেষণ

ট্রাম্পের জয় কি রক্ষণশীল আমেরিকার প্রতিশোধ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রান্তে তাঁর সমর্থন বাড়িয়েছেন। এমনকি প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর সমর্থন এবার বাড়তে দেখা গেছে। ট্রাম্পের এই জয় কি শুধু তাঁর নিজের জয়, নাকি এটা যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের জয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে লিখেছেন জিয়াউদ্দিন চৌধুরী

রক্ষণশীল আমেরিকা দীর্ঘ ঘুমের পরে জেগে উঠেছে। মার্কিন ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দু–দুবার অভিশংসিত এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে তাঁরা তাঁদের বলবান অবস্থান প্রমাণ করেছেন। রক্ষণশীলদের এই ঘাঁটিতে কেবল রিপাবলিকানরাই নন, তথাকথিত স্বতন্ত্রদের একটি বিশাল অংশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। 

তাঁরা এমন একজন অহমিকা আক্রান্ত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যিনি গত এক বছরে গলাবাজিতে কাউকে ছাড়েননি। যাঁদের তিনি অপছন্দ করেছেন বা যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য ন্যায্য বা অন্যায্য কোনো মন্তব্য করতে ছাড়েননি। 

হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বিরোধীদের উসকানি, আক্রমণ এমনকি ভয় দেখিয়েছেন। অবৈধ অভিবাসন, ভেঙে পড়া অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে দেশের বিপদের বিষয়ে তাঁর বানানো দাবি দিয়ে লাখ লাখ লোককে দলে আকৃষ্ট করার জন্য প্রতিটি উপায় অবলম্বন করেছিলেন। 

তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার অভিযোগ এবং নিজেকে জিঘাংসার শিকার হিসেবে চিত্রায়ণ দিনে দিনে তাঁর অনুগত ভক্তদের কাছ থেকে আরও সমর্থন তৈরি করেছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিটি ফেডারেল অভিযোগকে সম্মানের পদক হিসেবে নিয়ে ভোটারদের সহানুভূতি টানতে ব্যবহার করেছিলেন। সন্দেহ নেই, সফলও হয়েছেন। 

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প কি কেবল এসব কারণেই নিজের ভিত্তি এত প্রসারিত করে নির্বাচিত হয়েছেন? তিনি ইলেকটোরাল কলেজেই জয়ী হননি, ভোটারদের সহানুভূতি আদায়েও সফল হয়েছেন বলেই ৫২ শতাংশ জনপ্রিয় ভোট পেয়েছেন। 

■ রিপাবলিকান পার্টি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিতে রক্ষণশীলতাকে সমর্থন করেছে। এটা তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবেই করে আসছেন। ■ রিপাবলিকান পার্টিতে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের একটি বড় অংশ রক্ষণশীল। ট্রাম্পের নিজের রক্ষণশীল মনোভাব সেসব রক্ষণশীল ভোটারদের মনের মতো হয়েছিল। ■ রক্ষণশীল আমেরিকান চিন্তাভাবনার ছাঁচে বাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে যে নারীরা দুর্বল এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো পরিচালনা করতে পুরুষদের চেয়ে তাঁরা কম সক্ষম।

২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি ইউএস ক্যাপিটলে আনুষ্ঠানিক ভোট গণনা ব্যাহত করার জন্য যে দাঙ্গা তিনি করিয়েছিলেন, তা কি ভোটারদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে? ভোটাররা কি গত দুই বছরে দায়ের করা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলাকে ক্ষমা করেছেন? এর মধ্যে একটি মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তাহলে একজন নিন্দিত ব্যক্তির এই অভূতপূর্ব বিজয়কে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব?

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে অনেক নেতিবাচক আলোচনা আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলার আগে আসুন দেখা যাক ট্রাম্প কীভাবে তাঁর ভোটারদের ব্যাপ্তি বাড়ালেন। অর্থাৎ কোন কাজগুলো করে তিনি তাঁর নিজের ভোটারদের কাছে ইতিবাচক বলে প্রতিপন্ন হলেন, সেগুলো একটু একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

২০২২ সালে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের বেশি রিপাবলিকান ভোটার (৮৫%) শ্বেতাঙ্গ ছিলেন। আর ডেমোক্রেটিক ভোটারদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। পিউ গ্লোবাল রিসার্চের মতে, শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক ছিলেন। আর ৪১ শতাংশ ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে।

 রিপাবলিকান পার্টিতে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের একটি বড় অংশ রক্ষণশীল। ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত হওয়ার পরে দলের ভেতরে সমর্থনের জন্য তাঁকে আর পরিশ্রম করতে হয়নি। ট্রাম্পের নিজের রক্ষণশীল মনোভাব সেসব রক্ষণশীল ভোটারের মনের মতো হয়েছিল।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। দিনে দিনে তাঁর প্রতি বিভিন্ন রকম অভিযোগের হার বেড়েছে। কিন্তু এসবের ফলে ট্রাম্পের মর্যাদা এবং প্রার্থিতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের এক মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ ভোটার বলেছেন যে ট্রাম্প অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেলেও নভেম্বরে তাঁরা ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবেন। এই জরিপের মধ্যে ৭৪ শতাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন।

 রিপাবলিকান পার্টি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিতে রক্ষণশীলতাকে সমর্থন করেছে। এটা তারা ঐতিহ্যগতভাবেই করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাদ এবং যেকোনো উদ্যোগে সরকারের সীমিত হস্তক্ষেপ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা ব্যক্তি ও সমাজের অর্থনৈতিক বিষয়ে ন্যূনতম সরকারি হস্তক্ষেপের পক্ষপাতী।

একে বলে লেসেজ-ফেয়ার অর্থনীতি। রক্ষণশীলেরা সাধারণত কর হ্রাস, জনসাধারণের জন্য সরকারি ব্যয় হ্রাস, সর্বক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির ব্যবহার, বাজার বা অর্থনীতিতে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ না করা, বেসরকারীকরণ, ন্যূনতম সরকারি ঋণ এবং সুষম বাজেটকে সমর্থন করে।

সামাজিক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলেরা ধর্মীয় মূল্যবোধ, ঐতিহ্যগত আচরণবিধি, গর্ভপাতের ওপর বিধিনিষেধ ইত্যাদি প্রচার করে। এসব রক্ষণশীল মূল্যবোধে ট্রাম্প হয়তো বিশ্বাস করেন বা করেন না। কিন্তু নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক জীবন যাপন করেও দেশের রক্ষণশীলদের তিনি নিজের পক্ষে টানতে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছেন।

এ–ও যেন এক প্রহসন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে তাঁর মেয়াদে তিনজন রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ করেছেন। এই বিচারকেরা দেশে গর্ভপাত আইন বাতিল করেছেন। এর জন্য রক্ষণশীলদের কাছ থেকে তিনি প্রচুর কৃতজ্ঞতা পেয়েছিলেন। যাঁরা তাঁর দলের নন, এমন রক্ষণশীলেরাও এর জন্য ট্রাম্পকে কৃতজ্ঞতা জানাতে কার্পণ্য করেননি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণার শীর্ষ তিনটি বিষয়ের পরই রয়েছে অভিবাসন। পিউ রিসার্চ জানিয়েছে যে ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জন রিপাবলিকান এবং রিপাবলিকান-মনোভাবাপন্ন স্বতন্ত্র (৯১%) মার্কিন মেক্সিকো সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন। 

এঁদের মধ্যে ৭২ শতাংশ বলেছেন যে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ এবং অভিবাসনে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প আহ্বান জানিয়েছেন। 

এ আহ্বান সব রিপাবলিকান ও রক্ষণশীলদের ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। ট্রাম্প অভিবাসীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অভিবাসনকে গুলিয়ে ফেলে অবৈধ অভিবাসন বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বারবার তিনি বোঝাতে চাইছিলেন যে শুধু অবৈধ অভিবাসন নয়, মোটামুটি বিদেশিদের দেশে অভিবাসন ক্রমেই দেশের জাতিগত চিত্রকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাচ্ছে।

এ হচ্ছে যত দূর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে কেন ভোট পড়ল তার কিছু ব্যাখ্যা। এবার আসা যাক মার্কিন ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে তিনি যে এমনভাবে হারিয়ে দিতে পারলেন, এর কারণগুলোর দিকে।

প্রথম এবং সর্বাগ্রে বাধা ছিল একটি প্রতীকী চ্যালেঞ্জ। জ্যাকসন কাটজ নামে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক আছেন। তিনি পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কে লিখে থাকেন। 

কাটজ বলেছেন যে একজন পুরুষ প্রেসিডেন্ট ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক উপায়ে জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে আবদ্ধ একটি ভূমিকা দখল করেছেন। একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন আমেরিকান সামরিক বাহিনীর কমান্ডার। রাষ্ট্রকে যদি একটি পরিবার ধরা হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সেই পরিবারের কর্তা। 

একজন নারী যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে এই প্রথাগত ধারণা ভেঙে যায়। সন্দেহ নেই এই ছাঁচ ভাঙার চেষ্টা করলে যেকোনো নারীর জন্য পথটা হয়ে উঠবে জটিল। একজন রক্ষণশীল আমেরিকানের প্রচলিত ভাবমূর্তির সঙ্গে একজন নারী প্রেসিডেন্ট মানানসই নয়।

রক্ষণশীল আমেরিকান চিন্তাভাবনার ছাঁচে বাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে যে নারীরা দুর্বল এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো পরিচালনা করতে পুরুষদের চেয়ে তাঁরা কম সক্ষম। অন্য কথায়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন নারী খুব ঝুঁকিপূর্ণ বলেই রক্ষণশীলেরা মনে করেন। এ কারণেই ২০১৬ সালে ব্যর্থ হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন।

আরেকটি কারণ আছে। এ কারণ হয়তো আজকের দিনে আমেরিকায় রাজনৈতিকভাবে বলা অনুচিত বলে অনেকে বলেন না। তা হলো রক্ষণশীলদের চিন্তা এখনো বর্ণবাদী। যদিও বর্ণবাদী চিন্তাকে পেছনে ফেলে এই যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে বারাক ওবামাকে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। 

এবার সেই বর্ণবাদ কিছুটা হলেও সক্রিয় ছিল। বারাক ওবামা ছিলেন অর্ধেক শ্বেতাঙ্গ। এই অর্থে যে তাঁর মা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। কমলা হ্যারিস পুরোপুরি অশ্বেতাঙ্গ। তাঁর বাবা কৃষ্ণাঙ্গ, আর মা ভারতীয়। কথাটি নিয়ে অনেক তর্ক হতে পারে। তবে এটি কারণ হিসেবে একেবারে ফেলে দেওয়ারও উপায় নেই। 

২০২৪ সালে ট্রাম্পের এই বিজয় নিয়ে আগামী দিনে আরও অনেক পণ্ডিত আরও বহুভাবে বিশ্লেষণ ও আলোচনা করবেন। কমলা হ্যারিসের পরাজয় নিয়েও আলোচনা হবে। বিজয়ীর নিজের বিজয় নিয়ে ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। ব্যাখ্যা দিতে হয় পরাজিতকে। তাঁর পরাজয়ের কারণ খুঁজতে হয়। 

আমেরিকানদের একটি বড় অংশ তাঁদের চিন্তাভাবনায় রক্ষণশীল এবং ঐতিহ্যবাহী। তবে এই নির্বাচন, এর আগে হিলারি ক্লিনটনের পরাজয় বোধ হয় এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখে না যে যুক্তরাষ্ট্র এখনো একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেতে প্রস্তুত নয়।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি ও বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা