দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসলে কেমন হলো

ভালো বা সঠিক নির্বাচন অর্থ হলো, যে নির্বাচনে সঠিকভাবে জনগণের মতামতের প্রতিফলন হয়। সেটা সম্ভব হয় যখন নির্বাচন নিরপেক্ষ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়। এগুলোর যেকোনো একটির ব্যত্যয় হলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন বা ভালো নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয় না বা দেশে-বিদেশে সহজে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।

সংবিধান ও আইন যেকোনো ধরনের নির্বাচনকে বৈধতা দিতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে তা ভালো নির্বাচন হয়েছে বলে গ্রহণযোগ্যতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে আমরা কী বুঝি? এখানে সব ধরনের রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার সব রাজনৈতিক দলের নয়, বরং জনগণের বড় অংশের অংশগ্রহণকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায় বলে দাবি করেছিল।

সাধারণত বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ও তার মাধ্যমে জনগণের কাছে যথেষ্ট বিকল্প প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ ব্যতিরেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ ভোট দিতে উৎসাহিত হয় না।

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে কি না? নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, গড়ে প্রতিটি এলাকায় ভোটার উপস্থিতি প্রায় ৪২ শতাংশ। তবে আমাদের প্রার্থী-সমর্থক ও ভোটারদের বেশির ভাগের ধারণা, এ সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। সেই সংখ্যা সঠিক ধরে নিলেও দেশের প্রেক্ষাপটে যথেষ্টসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ছিল বলা যায় না।

জাতীয় নির্বাচনের পরিসংখ্যান

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫৫.৫৪ শতাংশ; ১২ জুন ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ; ১ অক্টোবর ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হয়েছিল।

এ নির্বাচনগুলো সর্বতোভাবে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি অংশগ্রহণমূলক হওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছে বলা যায় না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সংসদে কিছু কথা বলেছেন। তিনি কিছু দেশের ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান দিয়েছেন, যা আমাদের দেশের বর্তমান নির্বাচন থেকে কম। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনে সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। এ ভোটেই তাঁদের সার্বিক জনমতের প্রতিফলন হয় বলে তাঁরা দাবি করেন। এর বিপরীতে দেখা যায়, সঠিক নির্বাচনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় এক শ ভাগ ভোটারের উপস্থিতি প্রয়োজন মনে করা হয়। সে কারণে সেখানে ভোটদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

নানা কারণে, বিভিন্ন দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ভোটারের সংখ্যা ভিন্নতর হয়ে থাকে। আমাদের দেশের প্রয়োজনীয় ভোটার উপস্থিতির নিম্নতম সংখ্যা নির্ণয়ে যেসব জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে, সে নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান বিবেচনা করা যুক্তিসংগত মনে করি। সে কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে একমত হওয়া যায় না।

৪২ শতাংশ ভোট গ্রহণ কতটা যৌক্তিক

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার হলো ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। ভোট পড়েছে সরকারি হিসাবে ৫ কোটি ৩০ হাজার ১২২টি (৪১ দশমিক ৮ শতাংশ)। ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজর ৫৬৪টি। প্রতি কক্ষ বা বুথে ৮ ঘণ্টার নির্ধারিত সময়ে ভোট পড়েছে ১৯১টি। প্রতি ঘণ্টায় প্রতি বুথে গড়ে ভোট পড়েছে প্রায় ২৪টি। সে হিসাবে প্রতি ভোটের জন্য সময় পাওয়া যায় ২ দশমিক ৩০ মিনিট।

দেখা যায়, প্রতিটি ভোটদান সম্পন্ন করার জন্য কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন মিনিট সময় প্রয়োজন। সে মোতাবেক ৪২ শতাংশ ভোট সম্পন্ন হওয়ার জন্য সময় মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে এই পরিমাণ ভোট সম্পন্ন হওয়ার জন্য সারা দিন দেশব্যাপী প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রতিটি বুথের সামনে মোটামুটি নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক ভোট চলমান থাকার কথা।

কোনো কোনো এলাকায় ভোটারের কমবেশি উপস্থিতির কারণে গড় হিসাব ঠিক রাখতে অন্য কোনো কোনো বুথে নির্ধারিত সময় আট ঘণ্টার পরেও ভোটদানের জন্য ভোটাররা অপেক্ষমাণ থাকার কথা। উল্লেখ্য, নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী ভোটারদের (নির্দিষ্ট বেষ্টনীর ভেতরে অবস্থানরত) ভোটদানের সুযোগ দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ের পরও ভোট গ্রহণ অব্যাহত থাকতে পারে।

দেশের কোনো স্থানে কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে নির্দিষ্ট আট ঘণ্টা ধরে বা এরপরে অপেক্ষারত বা দণ্ডায়মান ভোটারদের লম্বা লাইন কেউ দেখেছে, দাবি করেননি। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে আমরা যা পেয়েছি, সাধারণভাবে ভোট গ্রহণ কেন্দ্র বা বুথে ঘণ্টায় গড়ে ৩ থেকে ৬ জনের বেশি ভোট দিতে দেখা যায়নি। ঘণ্টায় গড়ে ১২টি ভোট পড়েছে কিছুসংখ্যক এলাকায়। প্রায় এলাকাতেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি। তাঁদের অভিযোগ, ভোটকেন্দ্র দখল করে অবৈধ ভোট প্রদান করা হয়েছে।

আশঙ্কাজনক উপলব্ধি

ফলে ৪২ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি বাস্তবসম্মত নয় মনে করি। বরং ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন। কিছু কিছু এলাকায় ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণা।

স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কীভাবে গড়ে ৪২ শতাংশ ভোট হিসাবে গণনায় এল। এটা সম্ভব শুধু যদি বেশ কিছু ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মেরে প্রার্থীদের পক্ষে দেখানো হয়। অথবা ব্যালট গণনা বাদেই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের পছন্দমতো ফলাফল তৈরি ও ঘোষণা করেন।

যুক্তিসংগতভাবে আশঙ্কা করার কারণ আছে যে প্রচুর অতিরিক্ত ভোট, যা ভোটাররা দেননি, সেগুলো যেকোনো প্রকারে ফলাফলে দেখানো হয়েছে। যার পক্ষে দেখানো হয়েছে, তিনি জয়ী হয়েছেন। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাস্তবতার আলোকে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলা যায় না।

হাতে গোনা সামান্য কিছু নির্বাচনী এলাকায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ছিল। সেটাও হয়েছে মূলত সরকারের সদিচ্ছার কারণে। এসব নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারি দলের কোনো প্রার্থী সরাসরি বা পরোক্ষভাবে স্বতন্ত্র নামে সরকারদলীয় প্রার্থী ছিল না। আবার কোনো এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থীরাই ছিলেন প্রধান প্রার্থী। এসব এলাকায় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল বলা গেলেও অংশগ্রহণমূলক ছিল বলা যায় না।

একটি বড়সংখ্যক নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন হয়েছে মুক্ত কায়দায়। সেসব এলাকায় নির্বাচনসংক্রান্ত আচরণবিধিমালা মানার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। অবৈধ অর্থ, পেশিশক্তির ব্যবহারকে বাধা দেওয়া হয়নি। যে যেভাবে পেরেছেন, জয়লাভের চেষ্টা করেছেন—সেভাবেই বিজয়ী হয়েছেন। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভাড়াটে সৈনিকের মতো যে প্রার্থীর কাছে ভালো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, সেখানেই কাজ করেছেন।

একটি বড়সংখ্যক নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন হয়েছে মুক্ত কায়দায়। সেসব এলাকায় নির্বাচনসংক্রান্ত আচরণবিধিমালা মানার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। অবৈধ অর্থ, পেশিশক্তির ব্যবহারকে বাধা দেওয়া হয়নি। যে যেভাবে পেরেছেন, জয়লাভের চেষ্টা করেছেন—সেভাবেই বিজয়ী হয়েছেন।

অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভাড়াটে সৈনিকের মতো যে প্রার্থীর কাছে ভালো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, সেখানেই কাজ করেছেন। এ ধরনের এলাকার কোনো কোনোটিতে সরকারদলীয় প্রার্থী ছিল না, ছিল স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচিত কথিত বিদ্রোহী প্রার্থী বা জাতীয় পার্টির বা অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী।

আগেই বলেছি ও কারণসহ ব্যাখ্যা দিয়েছি যে প্রায় সব এলাকায় ভোটার উপস্থিতির হার কম হওয়ার ও অব্যবহৃত ব্যালট থাকার কারণে অবৈধ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ব্যালট ব্যবহার করে কোনো প্রার্থীর পক্ষে দেখানোর সুযোগ ছিল।

তা ছাড়া অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করার কারণ আছে মনে করি, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জন্য ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখানোর একটা তাগিদ ছিল। সে কারণেও নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছু অব্যবহৃত ব্যালট নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন।

সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচনটি ছিল প্রভাবিত ও সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উপরিউক্ত অভিযোগগুলোর পক্ষে কোনো বিচারিক রায় হয়নি, সেগুলোর আইনানুগ কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সে কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে সাধারণ জনগণের সিংহভাগই এ নির্বাচনকে ভালো নির্বাচন বা এ নির্বাচনে সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে মনে করে না।

প্রচলিত নির্বাচনী বিধিবিধানগুলো ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হতে দেখা গেছে। বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিজেরাই নিয়ম লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। ভবিষ্যতে একটি ভালো নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট আইনগুলো এমনকি সংবিধান পরিবর্তন করে পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান