মতামত

চীন প্রশ্নে ইউরোপের ‘ভাঙা আয়না’র নীতিতে লাভবান কারা

এবারের চীন সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।
এবারের চীন সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

নিজেকে ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে চান, এ রকম একজন নেতা এমানুয়েল মাখোঁ। তিনি বিভেদ তৈরি করার মতো যুক্তি মহাদেশটির অন্য নেতাদের প্ররোচিত করছেন। আর নিশ্চিতভাবেই সেটা উপভোগও করছেন। বেইজিং থেকে ফিরে আসার পর মাখোঁ বিষয়টিতে সর্বশেষ নজিরটি দেখালেন। এবারের চীন সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ নেতা এখন এই ভেবে বিহ্বল যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে যে গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে, সি চিন পিং তাইওয়ান গ্রাস করার কাজে সেটাকে ব্যবহার করতে পারেন। এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুললেন মাখোঁ। তাঁর ভাষ্য হলো, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তাইওয়ান ইস্যুতে ভিন্ন দৃষ্টি থেকে দেখা উচিত।

মাখোঁ বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, এ ধরনের ভাবনা যে আমরা ইউরোপিয়ানরা অবশ্যই আমেরিকানদের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলব এবং মানিয়ে নেব এবং চীনের প্রতি অতি প্রতিক্রিয়া দেখাব। বিষয়টি ইউরোপকে বিশ্বের শক্তিশালী তৃতীয় মেরু বানানোর চেয়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রের “অনুগত মহাদেশ” করে তুলছে।’

এরপর এ সপ্তাহে ক্রিমিয়ার সার্বভৌমত্ব বিষয়ে একেবারে খোলা বক্তব্য এল। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লু শায়ে শুধু ক্রিমিয়ার সার্বভৌমত্ব নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেননি, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সব স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিয়েই তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ক্রিমিয়া জোর করে দখল করে রেখেছে রাশিয়া। লু শায়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে...এই সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর কার্যকর মর্যাদা নেই।’

এই বক্তব্যে প্রথম প্রতিবাদ এসেছে লাটভিয়া, লিথুনিয়া ও এস্তোনিয়ার দিক থেকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত এই তিন দেশ হুমকির মুখে আছে।

বড় কোনো ভুল কিংবা ছোটখাটো সংকট হোক (বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট), এশিয়া ও ইউরোপের বেশির ভাগটাতে একটা বিষয় খোলাসা হয়ে গেছে। ইউরোপিয়ানরা ব্যাপারটি খুব গভীরভাব চিন্তা করছে না যে ভালো হোক বা মন্দ, চীন প্রশ্নে ইউরোপ একটি ‘ভাঙা আয়না’র নীতি গ্রহণ করেছে।

দূর থেকে এই নীতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত মনে হলেও খুব কাছ থেকে দেখলে দেখা যাবে, ইউরোপীয়দের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজন আছে।

মাখোঁর মন্তব্যগুলো অবশ্যই এই বিভক্তির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। চীন থেকে প্যারিসে নামতে না নামতেই মাখোঁর এই বক্তব্য কোনোভাবেই একজন রাষ্ট্রনায়কের দার্শনিক অনুধ্যান নয়। বরং, তাঁর বক্তব্য তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের বিভক্তির চিহ্ন।

লু শায়ের মন্তব্য এবং এই মন্তব্যের জেরে ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত ‘ভাঙা আয়না’ নীতি আরও ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তিটা ছোটখাটো হলেও সেটা বেইজিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কূটনীতিকেরা রাখঢাকহীন ও মারমুখী ভঙ্গিতে প্রায়ই কথা বলেন। তাঁদের কূটনীতির এই ভাষাকে ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ কূটনীতি বলে অভিহিত করা হয়। এটিকে তাঁরা বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান আস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন।

যেসব দেশ রাশিয়ার ভয়ে ভীত, তাদের দিক থেকেই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভাষায় প্রতিবাদ এসেছে। লাটভিয়া বলেছে, ‘সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য’। এস্তোনিয়া বলেছে,‘ধারণাতীত’। দেশটিতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকেও তলব করা হয়।

কিন্তু অন্যদের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি নরম। জার্মানি বিষয়টির স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার আহ্বান জানায় আর ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই মন্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত নন। কোনো দেশই দায়িত্বশীল চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর ব্যাখ্যা দাবি করেনি। বার্তা একই হতে পারে, কিন্তু সেটা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম থেকেই পার্থক্য তৈরি হয়।

এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তিটা ছোটখাটো হলেও সেটা বেইজিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কূটনীতিকেরা রাখঢাকহীন ও মারমুখী ভঙ্গিতে প্রায়ই কথা বলেন। তাঁদের কূটনীতির এই ভাষাকে ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ কূটনীতি বলে অভিহিত করা হয়। এটিকে তাঁরা বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান আস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন।

ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে অনেক বিষয়ে বিভাজন আছে, সেটা সুবিদিতও। আর ইউরোপের অন্য যেকোনো নেতার তুলনায় মাখোঁ সেটা খোলাখুলিই বলেন। গত বছরের শেষে তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, সে সময়ে তিনি ইউরোপে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মার্কিন নীতির সমালোচনা করেছিলেন।

ফ্রান্স মনে করছে যে যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ইউক্রেনপন্থী নীতির কারণে ইউরোপ চাপে পড়েছে। ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রীও একই ধরনের যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি হলো, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যখন বাড়ছে, সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোকে চীনের অর্থনীতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে বলছে। সরাসরি ভাষায় অর্থমন্ত্রী ব্রুনো ল্য মায়ের বলেছেন, ‘আমরা গ্রাম্য বুদ্ধু হতে চাই না। কে প্রতারিত হতে চাইবে বলুন, অন্যান্য শক্তি যখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করছে, তখন আমাদের সেটা করার অধিকার থাকবে না।’

এই বিষয় থেকেই বোঝা যায়, মাখোঁ ও লু শুয়ে ইউরোপের বিভক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করছেন। মাখোঁও খুব উচ্চ কণ্ঠে বলছেন, যাতে এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়। আর অন্যদিকে বেইজিং-বিষয়কে খোলা ময়দানে নিয়ে যাচ্ছে।

  • ফয়সাল আল ইয়াফি দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাবিষয়ক সংবাদদাতা

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত