মস্কোর সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানান স্বজনেরা
মস্কোর সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানান স্বজনেরা

মতামত

মস্কোয় হামলা পুতিনের আস্থায় বড় প্রভাব ফেলবে

মস্কোয় ক্রোকাস কনসার্ট হলে গত শুক্রবার সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার পরদিনই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘সন্ত্রাসীদের ও তাদের যারা মদদ দিয়েছে, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে সাজা দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিছু পর্যবেক্ষক এটিকে ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাবর্তন বলে মনে করছেন। কারণ, আবারও রাশিয়া একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়েছে; আবারও দেশটি সন্ত্রাসী হামলার কবলে পড়েছে এবং আবারও পুতিন রাশিয়ার চালকের আসনে বসেছেন।

২০০০ সালে চেচনিয়ায় যুদ্ধ চলছিল এবং ওই বছর মস্কোয় বোমা হামলা হয়েছিল। সে বছরই পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেছিলেন। তরুণ নেতা হিসেবে তিনি জাতিকে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি কাজও করেছিলেন।

পুতিন নৃশংস সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক কৌশলের সমন্বয়ে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পেরেছিলেন। চেচনিয়ার বর্তমান শাসক রমজান কাদিরভের বাবা ও চেচেনদের একটি বড় অংশের ধর্মীয় নেতা আখমদ কাদিরভকে ওই সময় পুতিন গভর্নর পদে বসিয়ে চেচেনদের বিভক্ত করে ফেলতে সক্ষম হন। এর ফলে চেচেন বিদ্রোহ দমে যায় এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও কমে যায়। রাশিয়ায় সর্বশেষ বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল ২০১১ সালে।

রুশ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পুতিনের সাফল্যকে তাঁর অন্যতম অর্জন বলে ধরা হয় এবং তাঁর রাজনৈতিক দীর্ঘায়ুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবেও এটিকে মনে করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী এক দশকজুড়ে রাশিয়ায় অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা ছিল। পুতিন গদিতে বসার পর তিনি রাশিয়াকে একটি ভারসাম্যমূলক ও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকারও করা হয়ে থাকে।

যে হুমকিতে আর কোনো দিন পড়তে হবে না বলে রাশিয়ার মানুষ আশা করছিল, ৩০ বছর পর আজ সেই হুমকিই ফিরে এসেছে। আজ সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রুশ সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক বয়স্ক হয়ে পড়া পুতিন সেই ৩০ বছর আগের মতোই এখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য এবার এই হামলার জন্য অনেকে তাঁকেও দায়ী করছেন। এ কারণে এখন প্রশ্ন উঠছে, এখন কি তাঁকে আগের মতো বিশ্বাস করা হবে?

যুদ্ধ-পর্যবেক্ষণকারী কিছু ক্রেমলিনপন্থী ভাষ্যকার মস্কোয় হামলার জন্য আমেরিকার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এবং দাবি করেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানকে দুর্বল করার জন্য আমেরিকা সেখানে আইএসকেপিকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। মস্কোর এই সর্বশেষ হামলাকে তঁারা পুতিনের পাতানো হামলা বলে দাবি করছেন।

ক্রোকাস কনসার্ট হলে যে হামলা হয়েছে, আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। এটি ইউক্রেনে রাশিয়ার নৃশংস আগ্রাসনের পটভূমিতে ঘটেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুতিন ও তাঁর নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এর সঙ্গে ইউক্রেনকে জড়িয়ে ফেলেছে।

হামলাকারীদের মধ্য থেকে চারজন হুড়োহুড়ি করে পালানো লোকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ইউক্রেন সীমান্তের ১৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা থেকে তাঁদের পাকড়াও করা হয়। এরপরই এই ঘটনার সঙ্গে ইউক্রেনের যোগসাজশ থাকার দাবি করে রাশিয়া। পুতিন নিজে দাবি করেছেন, হামলাকারীদের পালানোর জন্য ইউক্রেন তাদের সীমান্তে ‘খোলা জানালা’র ব্যবস্থা রেখেছিল।

ইউক্রেন পুতিনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও জোর দিয়ে বলেছে, এটি আইএসকের কাজ এবং তাতে ইউক্রেনের কোনো হাত নেই। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এ ধরনের হামলা হতে পারে বলে তারা আগেই খবর পেয়েছিল এবং সে তথ্য তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও দিয়েছিল।

ক্রেমলিনপন্থী যে সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকেরা মস্কোর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের যোগসাজশ পাচ্ছেন, তাঁরা ইউক্রেন-যুদ্ধকে সমর্থন করা ব্লগার মাকসিম ফোমিন (যিনি ভ্লাদলেন তাতারস্কি নামে বেশি পরিচিত) এবং কট্টর দক্ষিণপন্থী আলেকসান্দর দুগিনের মেয়ে দারিয়া দুগিনকে বোমা মেরে হত্যা করার পেছনে ইউক্রেনের হাত থাকার সন্দেহ করেন। এ ছাড়া অধিকৃত ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সংযোগ স্থাপন করা একটি সেতুও কিছুদিন আগে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধ-পর্যবেক্ষণকারী কিছু ক্রেমলিনপন্থী ভাষ্যকার মস্কোয় হামলার জন্য আমেরিকার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এবং দাবি করেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানকে দুর্বল করার জন্য আমেরিকা সেখানে আইএসকেপিকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। মস্কোর এই সর্বশেষ হামলাকে তঁারা পুতিনের পাতানো হামলা বলে দাবি করছেন। হামলাকারী হিসেবে যাদের ধরা হয়েছে, তাদের রাশিয়ায় কাজের খোঁজে আসা ১৩ লাখ তাজিক শ্রমিকের মতোই সাধারণ প্রবাসী তাজিক নাগরিক বলে মনে হচ্ছে।

তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, আটক ব্যক্তিদের একজন বলেছেন, একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতার এক সহকারী তাঁকে পাঁচ হাজার ইউরোর বিনিময়ে ভাড়া করেছিলেন। তবে এসব স্বীকারোক্তি আদায়ের সময় তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে এবং একজনের কান কেটে ফেলা হয়েছে।

কথা হচ্ছে কারা তাদের ভাড়া করেছিলেন, তা বড় কথা নয়। বড় বিষয় হলো এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার জনগণের মনোবল ভেঙে দেওয়া। তাহলে কি এই ট্র্যাজেডি এড়াতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সবাই পুতিনকে দোষারোপ করতে পারেন? অনেকে হয়তো পারেন, কিন্তু রাশিয়ায় প্রকাশ্যে বসে নয়। তবে এই ঘটনায় পুতিনের ওপর যে জনগণের আস্থা কমবে, তা ধারণা করা যায়।

  •  লিওনিদ রাগোজিন রিগাভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত