মোদি ও এরদোয়ানের ওপর নাখোশ কেন বাইডেন

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ভারত সফর। নয়াদিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শেষে। ১ মে, ২০১৭
ছবি: এএফপি

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের ফাঁকে গত ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্করের সঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর বৈঠকের পর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে একটি মৃদু ‘ভূকম্পন’ ঘটে গেছে। কারণ ওই বৈঠকে তাঁদের আলোচনায় সাইপ্রাস ইস্যুও ছিল। জয়শঙ্কর এক টুইট বার্তায় সে কথা নিজেই তুলে ধরেন।

এর এক দিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের চলমান সমস্যার সমাধান চেয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে বিষয়ের সঙ্গে জয়শঙ্কর-কাভুসোগলুর বৈঠকে আলোচিত সাইপ্রাসের বিষয়টিকে মিলিয়ে দেখছে।

১৯২৩ সালে ঐতিহাসিক লুজানে চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলে আসছে, ঠিক একইভাবে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সাইপ্রাসের মালিকানার দাবি নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে গ্রিসসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বন্দ্ব চলে আসছে।

এমনিতে শান্তিচুক্তির সৌন্দর্য হলো এই ধরনের চুক্তিতে সাধারণত কোনো ‘মেয়াদকাল’ থাকে না। কিন্তু লুজানে চুক্তিতে উল্লেখ করা ছিল, এই চুক্তির মেয়াদ থাকবে ১০০ বছর। এই চুক্তির এক পক্ষে ছিল তুরস্ক, আরেক পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস ও তাদের সহযোগীরা।

তুরস্ক ও ভারতের ঘনিষ্ঠতাকে সহজভাবে যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারছে না। ফলে একদিকে ভারতকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলতে কাশ্মীর ইস্যুতে ফের উচ্চকিত হওয়া পাকিস্তানকে বাইডেন সরকার সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে তুরস্ককে চাপে রাখতে বাইডেন সাইপ্রাসকে আধুনিক সমরাস্ত্র দিতে যাচ্ছে

আসন্ন ২০২৩ সালে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সে বিষয়টিকেই তুরস্ক তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এগোচ্ছে। চুক্তির শর্ত মোতাবেক, আগামী বছরের ২৪ জুলাই তুরস্কের আধুনিক সীমানা ‘অপ্রচলিত’ হয়ে যাবে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তাত্ত্বিকভাবে তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বিশাল জ্বালানি সম্পদের অধিকারী হবে। যেহেতু আইনি দিক থেকে ওই অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির মালিক হবে তুরস্ক, তাই এরদোয়ান তার দখলে যাওয়ার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তুরস্ক সরকারের দিক থেকে আভাস দেওয়া হচ্ছে।

সে কারণে তুরস্কর সঙ্গে গ্রিস ও সাইপ্রাসের উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। এ বিষয়ে পশ্চিমা দুনিয়াও সতর্ক নজর রাখছে এবং তুরস্ককে প্রতিহত করার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে।

জয়শংকর ও কাভুসোগলুর বৈঠকের পাঁচ দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, গ্রিস–সংলগ্ন সাইপ্রাসের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিষেধাজ্ঞা ২০২৩ সালের জন্য তুলে নেওয়া হবে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সাইপ্রাসে ভারী সমরাস্ত্র বিক্রি করতে পারবে। তুরস্ক লুজানে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার যুক্তি দিয়ে সাইপ্রাসের পূর্ণ দখল নিতে চাইলে সাইপ্রাস যাতে প্রতিহত করতে পারে, সে দিকটি মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে আরও ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করেছে। এতে ওই এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে বলেও তুরস্ক হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

এখন জয়শঙ্কর ও কাভুসোগলু বৈঠকে সাইপ্রাস নিয়ে কী আলোচনা করেছেন তা জানা যায়নি। তবে পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্র ৪৫ কোটি ডলারের যে প্যাকেজ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, তার সঙ্গে সাইপ্রাসকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টিকে এক করে দেখছে ভারত।

এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক-সাইপ্রাস—এ ত্রিপক্ষীয় চক্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চক্রের মিল আছে। উভয় ক্ষেত্রেই নিকোসিয়া এবং ইসলামাবাদের মার্কিনপন্থী সরকারকে জো বাইডেনের সরকার সহায়তা দিচ্ছে। এ সহায়তা আঙ্কারা ও দিল্লির গদিতে আসীন জাতীয়তাবাদী সরকারকে ব্যথিত করছে।

মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তুরস্ক ও ভারত উভয়ই তাতে সমর্থন দেয়নি। সে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে রাগিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে তুরস্ক এবং ভারতের প্রভাব আরও বাড়তে থাকলে তা বৈশ্বিক খবরদারিতে ওয়াশিংটনের জোরকে কমিয়ে দেবে।

সমরখন্দে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে এরদোয়ান-পুতিন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই ছবি বাইডেনকে নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ করেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আয়োজিত ওই সম্মেলনে মোদি উচ্ছ্বাসপূর্ণ কণ্ঠে পুতিনের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘ভারত ও রাশিয়ার ঐতিহাসিক সম্পর্ক চির অটুট থাকবে’।

মোদির এ কথা নিশ্চয়ই বাইডেনের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। অবাক করা খবর হলো মোদি-পুতিনের বৈঠকের খবরটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রায় চেপে যাওয়া হয়েছে।

সমরখন্দে মোদি ও এরদোয়ানের বৈঠকের পর তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি ওয়ার্ল্ড একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা করে, ‘আগামী দিনগুলোতে ভারত ও তুরস্কের সম্পর্ক আরও উজ্জ্বল হবে।’ তুরস্ক ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠতাকেও সহজভাবে যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারছে না।

ফলে একদিকে ভারতকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলতে কাশ্মীর ইস্যুতে ফের উচ্চকিত হওয়া পাকিস্তানকে বাইডেন সরকার সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে তুরস্ককে চাপে রাখতে বাইডেন সাইপ্রাসকে আধুনিক সমরাস্ত্র দিতে যাচ্ছে।

 এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • এম কে ভদ্রকুমার ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক