ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই

মতামত

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা: বিচারপ্রক্রিয়া যেন বিতর্কিত না হয় 

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশত্যাগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও একটি অভিযোগ এসেছে। পাশাপাশি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রশ্ন করেছে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কি না। তাঁরা সেটি খতিয়ে দেখেছেন। তাতে তাঁরা দেখেছেন, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যাঁরা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব’ (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২৪)। 

আসিফ নজরুল এ-ও বলেন, ‘এসব ঘটনার তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে’ (বাসস, ১৪ আগস্ট ২০২৪)। অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টেলিফোনে আলোচনা হয়েছে যে আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের হত্যার ঘটনায় জাতিসংঘ শিগগিরই তদন্ত শুরু করবে (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২৪)। 

এই ঘটনাবলির দুটি দিক আছে—একটি হচ্ছে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার বিচার। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের মধ্য দিয়ে ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র জন্য হাসিনা এবং অন্যরা অভিযুক্ত হবেন কি না, সেটা তদন্তের প্রকৃতি এবং পরিসরের ওপরে নির্ভর করবে। এ ক্ষেত্রে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্য খানিকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ তদন্ত করে, তা করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। ফলকার টুর্ক যে তদন্তের কথা বলছেন, তা সম্ভবত ওই ধরনের স্বাধীন তদন্ত। 

এ বিষয়ে ১৪ আগস্ট জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে এটাই জানতে পারি যে এ জন্য দরকার হবে লিখিতভাবে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এবং সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এই নিশ্চয়তা চাইবে যে তারা যে সহযোগিতা চাইবে, তা দিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ করা দরকার, তা হচ্ছে এমনভাবে অনুরোধ না করা, যাতে জাতিসংঘ অপারগতা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। এ ধরনের অপারগতা টেকনিক্যাল কারণে জানানো হলেও তা ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সমর্থক এবং ওই সরকারের বিদেশি সমর্থকেরা তখন কোনো ধরনের অপরাধ হয়নি বলে প্রচারের সুযোগ পাবে। এ বিষয়ে সরকার যত দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাবে, ততই ভালো—সেটা অপরাধের সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহের জন্যই দরকার।

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিচারের দাবির প্রেক্ষাপটটি স্মরণ করা দরকার। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টি তিনি পদত্যাগের আগেই দেশের বাইরে আলোচিত হচ্ছিল। সেই দিকে ইঙ্গিত করে ৯ আগস্ট আমি লিখেছিলাম যে ক্ষমতাচ্যুতির আগের দিনগুলোতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনার বিচার হওয়া দরকার; সেই লক্ষ্যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেকার চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে পারে অথবা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের জন্য পাঠাতে পারে (হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে, প্রথম আলো, ৯ আগস্ট ২০২৪)।  

রোম স্টাটিউটে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলে ওই ব্যক্তির বিচার করা। বাংলাদেশ এই স্টাটিউটের স্বাক্ষরকারী দেশ। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে বলে প্রতীয়মান কোনো ব্যক্তির বিচার করতে সংশ্লিষ্ট কোনো দেশ অনাগ্রহী বা অপারগ হলে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) এই বিচারের জন্য আবেদন করতে পারে।

একটি দেশ অনাগ্রহী কি না, তা বোঝা যায় যদি এই বিষয়ে তারা কোনো পদক্ষেপ না নেয়, সময় ক্ষেপণ করে, যদি নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ বা স্বাধীন নজরদারির ব্যবস্থা কার্যকর না থাকে। অন্যদিকে একটি দেশের অপারগতা হচ্ছে যখন ওই দেশের বিচার বিভাগ এতটাই দুর্বল যে তার পক্ষে যথাযথ বিচার সম্ভব নয়। আইসিসিতে দুই কারণেই বিচারের ইতিহাস আছে। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার পরামর্শ ছিল বিচার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সামগ্রিক দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইসিসিকে বিচারের প্রক্রিয়া শুরুর অনুরোধ করা। এই বক্তব্যের পরে ওই দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করে তাঁর বিচার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ২০২৪)। 

পুলিশ ও আদালতের আচরণ এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এমন আচরণ করা ঠিক হবে না, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধকে লঘু করে দিয়ে অন্যান্য বিষয়কে প্রধান করে ফেলে। মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে, অধিকাংশ মানুষ এই অভ্যুত্থানের মধ্যে তৈরি সরকারের কাছে আশা করে যে তাদের আচরণ হবে আইনানুগ; কেননা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশকে বদলে দেওয়া যাবে না।

এখানে স্মরণ রাখতে হবে, রোম স্টাটিউটে কেবল হত্যাকাণ্ডকেই মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য করেনি। এর ৭ অনুচ্ছেদে যেসব অপরাধকে মানবতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে নিপীড়ন ও গুম (বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) আছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন; ‘আয়নাঘর’-এ কতজন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাঁর সঠিক হিসাব নেই। এর সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা যায় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনার অজ্ঞাতে এসব ঘটেছে, এমন মনে করার কারণ নেই। 

ফলে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা এবং সরকার ফৌজদারি মামলা করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। শেখ হাসিনার বিষয়ে অফিস অব দ্য প্রসিকিউটরের সঙ্গে বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয় আলোচনা করতে পারে। এর আরেকটি দিক হচ্ছে এতে ভারতের ওপরে চাপ পড়বে যে তারা হাসিনাকে কত দিন আশ্রয় দেবে। 

সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের যে কথা বলা হয়েছে, তা দৃশ্যত বিচার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের আস্থার প্রতিফলন ঘটায়। ১৯৭৩ সালের যে আইনের আওতায় (যা ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়েছে) গঠিত এই ট্রাইব্যুনালকে জাতিসংঘ সহযোগিতা করতে পারবে না। কেননা এই আইনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। জাতিসংঘ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় না। জেনেভায় অবস্থানরত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একজন কর্মকর্তা আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।  

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়াগত ত্রুটির বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুরু থেকেই আপত্তি করে আসছে। এখন এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে এই সমালোচনাগুলোকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ন্যায়বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা বলেই দাবি করবেন, যদিও তাঁরা তখন এগুলোকে আমলে নেননি| সম্ভাব্য এসব বিতর্ক এড়ানোর জন্য এখন যদি প্রক্রিয়ায় কোনো সংশোধনী আনা হয়, তা-ও এই ধারণাই দেবে যে তা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সরকারের এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কারণ, ইতিমধ্যে সংঘটিত কিছু বিষয় আইনি প্রক্রিয়া এবং পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটি। 

পুলিশ ও আদালতের আচরণ এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এমন আচরণ করা ঠিক হবে না, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধকে লঘু করে দিয়ে অন্যান্য বিষয়কে প্রধান করে ফেলে। মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে, অধিকাংশ মানুষ এই অভ্যুত্থানের মধ্যে তৈরি সরকারের কাছে আশা করে যে তাদের আচরণ হবে আইনানুগ; কেননা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশকে বদলে দেওয়া যাবে না। এই সরকারের অনেক গুরুদায়িত্বের একটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা, তা করতে হবে এমনভাবে যেন এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় ন্যায়বিচার হয়েছে। এটা আন্দোলনের শহীদদের কাছেও সবার ঋণ। 


আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক