নতুন চিন্তা গ্রহণ কিংবা কোনো পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করেন তরুণেরা। কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবেই এ দেশের সমাজ দাদামশাই-গুরুমশাইদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে শত শত বছর ধরে প্রায় পরিবর্তনহীন এক অনড় সমাজের চিত্রই ছিল বাস্তবতা। এর মধ্যে গত শতকের অন্তত তিনটি দশক ব্যতিক্রম।
সে সময়ের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। যাত্রাটা শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশকে, ষাটের দশকে যা সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠে। সে ধাক্কায় ১৯৭১ সালে বিশ্বের বুকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
তিন দশকের সেই ধাক্কা কিংবা পরিবর্তনের রেশ আরও দুই দশক পর্যন্ত অস্তিত্বশীল থেকেছে। কিন্তু নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সেই যুগের সমাপ্তি হয়।
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে তরুণেরা আবার অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মকে বাদ দিয়ে কিংবা সরিয়ে রাখার সব রকম আয়োজন চলছে সমাজ ও রাজনীতিতে।
মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ এখন তরুণ। ন্যায্য হিস্যা তো দূরে থাক, রাজনৈতিক দলগুলোয় তরুণদের প্রতিনিধিত্ব কুপি জ্বেলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে তরুণেরা সমাজ পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলেন, তাঁরাই বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। মাঠ দখলের লাঠিয়াল ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তরুণদের আর কি কোনো মূল্য আছে?
গত দুই দশকে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বিশ্ব এক বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় অংশীজন তরুণেরা। সারা বিশ্ব হাতের মুঠোতে আসায় বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ঘটনা, চিন্তা, মত পৌঁছাতে এখন আর দেরি হয় না। ফলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সম-অধিকার, লিঙ্গসমতা, পোশাকের স্বাধীনতা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে তরুণদের একটা অংশ যেকোনো সময়ের চেয়ে সচেতন। আবার একই সঙ্গে নানা ধরনের রক্ষণশীল, বিদ্বেষপূর্ণ চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত হওয়ার হারও তাঁদের মধ্যে বেশি।
রাজনৈতিক-অর্থনীতির এই অনড় ব্যবস্থা গেড়ে বসেছে বাংলাদেশে। এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু পরিবর্তনের কথা বলতে গেলেই সামনে ঝুলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিবর্তক আইন। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চার বছর আগে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, তার ৪৭ শতাংশের বাদী পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
ডিজিটাল বিশ্বে চিন্তা ও মতের সংযুক্তি বা কানেকটিভিটি ঘটছে এবং তরুণদের মাঝে শক্তভাবে মত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই মত স্বাভাবিকভাবে প্রকাশের রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্র নেই। বরং তাদের মতকে রুদ্ধ করে দেওয়ার নানা ধরনের দমনমূলক আইন তৈরি করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া, বিদ্বেষ, ঘৃণা, হতাশা কিংবা ট্রল আমরা দেখি, তা এই অস্বাভাবিক বাস্তবতার একটি বহিঃপ্রকাশ।
সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে তরুণ (১৫ থেকে ২৯ বছর) জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। বিশাল এই তারুণ্য যেকোনো সমাজের জন্যই অমিত এক সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর নীতি-পরিকল্পনা কোথায়? রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে তরুণদের জীবনমান পরিবর্তনে নানা অঙ্গীকার করে। বিশেষ বিশেষ দিনের বক্তৃতায় তরুণদের জন্যই যে নেতারা রাজনীতি করেন, সে বক্তব্য দিতেও ভুল করেন না। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা হতাশাজনক।
বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের। তাঁদের ৬৭ শতাংশই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ।
কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ১২–১৩ শতাংশ তরুণ আনুষ্ঠানিক খাতে বা সম্মানজনক বেতনে চাকরি পাচ্ছেন। দেশের নেতারা তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু সেখানেও এমন বিরুদ্ধ পরিবেশ ও অনড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে যে তরুণেরা চাইলেও উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবসার সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম।
এ পরিস্থিতিতে তরুণদের বড় একটা অংশ নিরুপায় হয়ে প্রবাসে সস্তা শ্রমের শ্রমিক হচ্ছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজটাও করা হচ্ছে না। আবার দালালদের খপ্পরে পড়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে, রোদে পুড়ে, শীতে জমে, কারাগারে ধুঁকে অসংখ্য তরুণের প্রাণ যাচ্ছে।
প্রায় সোয়া কোটি প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সেই অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে। আবার সেই টাকার একটা বড় অংশই রাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত একটা সুবিধাভোগী অংশ পাচার করে দিচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে সংকট কাটছে না। সেটা মোকাবিলায় সহজ পথ হিসেবে জনগণের ওপর জ্বালানির বাড়তি মূল্য কিংবা বৈষম্যমূলক কর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক-অর্থনীতির এই অনড় ব্যবস্থা গেড়ে বসেছে বাংলাদেশে। এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু পরিবর্তনের কথা বলতে গেলেই সামনে ঝুলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিবর্তক আইন। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চার বছর আগে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, তার ৪৭ শতাংশের বাদী পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
বাস্তব জগতেও যেকোনো পরিবর্তনের জন্য তরুণদের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা ভয়ংকরভাবে দমন করা চলছে। ২০১৮ সালে সড়কে সবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য দেশের কিশোরেরা নজিরবিহীনভাবে গড়ে তুলেছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। পুলিশ ও ছাত্রলীগের ‘হেলমেট বাহিনী’ নির্মমভাবে পিটিয়ে সেই আন্দোলন দমন করেছিল।
তরুণদের মতামত, আশা-আকাঙ্ক্ষা যে রাজনৈতিকভাবে বিবেচ্য বিষয় নয়, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সংলাপ। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে সংলাপ করলেও তরুণসমাজের প্রতিনিধিদের ডাকার প্রয়োজন বোধ করেনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের কোনো আলামত দেখেন কি—এমন প্রশ্নে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সদ্য প্রয়াত আকবর আলি খান বলেছেন, ‘এমন সম্ভাবনা ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে নেই। তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে তরুণেরা। বর্তমান নেতৃত্ব হচ্ছে পুরোনো। এদের কবল থেকে বের হয়ে তরুণ নেতৃত্ব গড়তে পারলে এখানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আছে। নয়তো যেভাবে চলছে, সেভাবে চলবে। তবে আমি আশা করতে পারি, তরুণ শক্তি জেগে উঠবে। এরা কারা আমি জানি না। তবে তাদের ওপর আমার আস্থা আছে।’
প্রদোষের এ অন্ধকারে সেই আস্থা অন্তত আমাদের মধ্যে বেঁচে থাক।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক