২৯ জানুয়ারির প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখায় নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে নকলের কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। ‘পাঠ্যপুস্তক: এবার ব্লগ ও কোচিং সেন্টারের ওয়েবসাইট থেকে কপি’ শিরোনামে এ লেখাটি লিখেছেন লেখক ও গবেষক নাদিম মাহমুদ।
আমি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সরাসরি এ বইটির লেখক নই। তারপরও ব্যক্তিগত কৌতূহল ও পেশাদার বিজ্ঞানী হওয়ার অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ এই লেখায় দিচ্ছি। আমার এই বক্তব্য একান্তই নিজস্ব এবং এটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা লেখকদের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
প্রথম অভিযোগ: নবম শ্রেণির ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে তৃতীয় পৃষ্ঠায় ১.১.১ অনুচ্ছেদের উদাহরণগুলো মিসরভিত্তিক একটি সফটওয়্যার কোম্পানির ব্লগ থেকে নেওয়া।
আমার পর্যবেক্ষণ: এই অভিযোগের মূল কথা হলো, স্থিতি ও গতি জড়তার উদাহরণ হিসেবে একটি বাসের হঠাৎ চলতে শুরু করা বা থেমে যাওয়ার কারণে বাসযাত্রীর পেছনে হেলে পড়া বা সামনে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপারটি নাকি লেখকেরা মিসরের প্র্যাক্সিস ল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে চুরি করেছেন।
আমার মতো যাদের স্কুল থেকে শুরু করে পিএইচডি পর্যন্ত পদার্থবিদ্যা পড়তে হয়েছে, তারা শিক্ষকদের কিছু সাধারণ উদাহরণ ব্যবহার করতে দেখেছেন। যেমন: তরঙ্গ ও শব্দ বিষয়ে প্রায় প্রতিটি বইয়েই পুকুরের পানিতে ঢিল ছুড়ে তরঙ্গ তৈরির উদাহরণটি বলা হয়েছে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে এসব বইয়ের লেখকেরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে চুরি করে লিখেছেন।
যেকোনো বিষয় পড়ানোর সময় এমন কিছু উদাহরণ ব্যবহার করা হয়, যেটির সঙ্গে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায়। কেউ যদি একটু কষ্ট করে ‘examples of inertia with a bus passenger’ লিখে গুগলে খুঁজে দেখেন, তাহলে খুব সম্ভবত ১০০টির ওপরে ওয়েবসাইট পাবেন। নিচে দেখুন।
প্রিয় পাঠক, আপনারাই বলুন বাসে যাত্রীর উদাহরণটি শুধুই প্র্যাক্সিসল্যাবের আবিষ্কার নাকি একটি এই পর্যায়ের শিক্ষাদানে একটি খুবই সাধারণ উদাহরণ?
দ্বিতীয় অভিযোগ: স্থিতিজড়তার উদাহরণ হিসেবে গ্লাসের ওপর শক্ত কাগজে মুদ্রা রেখে হ্যাঁচকা টানের উদাহরণটি একই মিসরীয় ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
আমার পর্যবেক্ষণ: এখানেও বক্তব্য একই। আমি নিচে examples of inertia with coin, cardboard and glass লিখে গুগলে খুঁজলে কী আসে তা দিলাম। আক্ষরিক অর্থেই যেকোনো স্থিতিজড়তার আলোচনায় এটি একটি সাধারণ উদাহরণ। নিচের ছবি দেখে পাঠক আপনারাই বিচার করুন আলাদাভাবে মিসরীয় সেই ওয়েবসাইটটিকে উৎস হিসেবে বিবেচনা করার কোনো অবকাশ আছে কি না!
তৃতীয় অভিযোগ: দশম অধ্যায়ের ১৫০ পৃষ্ঠায় ক্লোরোপ্লাস্টের গঠনের বর্ণনাটি সিডি-জিনোমিকস ওয়েবসাইট থেকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ঠিক রেখে হুবহু নকল করা।
আমার পর্যবেক্ষণ: আমরা বাক্যগুলোকে ক্রমানুসারে পাশাপাশি বসাই।
শেষের দুটি বাক্যে ভাবানুবাদ ধরতে চাইলেও অনেক পার্থক্য আছে। আর প্রথম বাক্যটি আরও ভালো মিলে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সঙ্গে। একটি পাঠ্যবইয়ে বিশ্বকোষ থেকে তথ্য থাকাটি স্বাভাবিক। আর যে বাক্যের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ক্লোরোপ্লাস্টের ব্যাস আর পুরুত্বের তথ্য দেওয়া সেটি ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্টতি অগ্রে’ বললে ভালো হবে, নাকি ‘নীরস তরুবর ভাতি পুরোভাগে’ বলা উচিত, নবম শ্রেণির জন্য এই আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক।
সম্পূরক অভিযোগ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘এ বইয়ে ক্লোরোফিল, থাইলাকয়েড ও গ্র্যানামের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হুবহু ওই ওয়েবসাইটে থেকে নেওয়া হয়েছে। চলুন মিলিয়ে দেখি।
প্রিয় পাঠক, কথাগুলো কি হুবহু ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে?
চতুর্থ অভিযোগ: অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ১২ নম্বর অধ্যায় বাস্তুতন্ত্রের নাইট্রোজেন চক্র ভারতের একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষাসহায়িকা থেকে নেওয়া।
আমার পর্যবেক্ষণ: যথারীতি আমরা ক্রমানুসারে বাক্যগুলো মিলিয়ে দেখব। নিচের ছবিটি দেখে প্রিয় পাঠক বলুন, ‘কপি-পেস্ট’ কি করা হয়েছে?
একটি সম্পূরক অভিযোগ করা হয়েছে যে নাইট্রোজেন চক্রের চারটি পয়েন্টও বাইজুস থেকে হুবহু বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।
পঞ্চম অভিযোগ: ১১টি চিত্র নকল।
আমার পর্যবেক্ষণ: প্রথম অভিযোগটি হলো বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের ছবিটি নাকি নকল করা হয়েছে মিডিয়াম ডট কম থেকে। এই চিত্রকর্ম থমাস বার্লোর আঁকা। তিনি স্যার গডফ্রে নেলারের আঁকা নিউটনের প্রতিকৃতি নকল করে এটি এঁকেছেন। ছবিটি পাবলিক ডোমেইনের অংশ হিসেবে উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত!
এরপর অভিযোগ করা হয়েছে চিত্র ১.১ নেওয়া হয়েছে মিডিয়াম ডটকম থেকে। এটি নিয়ে আমার বক্তব্য আমি দ্বিতীয় অভিযোগের বিপরীতে আমার পর্যবেক্ষণে ওপরে বলেছি। আর চিত্র ১.২ এর মতো অসংখ্য ছবি আমি ওপরে প্রথম অভিযোগ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণে দিয়েছি।
লেখক কেন খামাখা প্র্যাক্সিস ল্যাবকে এত কৃতিত্ব দিচ্ছেন জানি না। এভাবে চললে পৃথিবীর সব পদার্থবিদই তো ‘চোর’ বলে সাব্যস্ত হবেন।
এরপর চিত্র ১.৯ এ নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার ছবিটি নাকি নেওয়া হয়েছে জন এম জেনিংস ডটকম থেকে। চলুন চিত্র দুটি পাশাপাশি বসাই।
আমি পাঠকের চোখের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করি।
এরপর অভিযোগ করা হয়েছে পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনে তাপের প্রভাবসংক্রান্ত চিত্র ২.৭ প্রিন্টারেস্ট ডট কম থেকে নিয়ে আবার অঙ্কন করা হয়েছে। যেকোনো পাঠক একটু কষ্ট করে গুগলে স্টেটস অব ম্যাটার দিয়ে খুঁজলেই দেখবেন, কাছাকাছি রকমের অসংখ্য চিত্র আছে।
যেহেতু নবম শ্রেণির বাচ্চারা বরফ, পানি, বাষ্প—এসব সাধারণ ধারণার সঙ্গে পরিচিত, কাজেই পদার্থের দশা পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় এগুলো বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ হওয়াটা স্বাভাবিক। খেয়াল করলেই বোঝা যাবে ছবি দুটি দুজন পৃথক শিল্পীর আঁকা। অভিযোগকারী লেখক যে ছবির রেফারেন্স দিয়েছেন, তার শিল্পী অ্যালেক্সেই ইগরভ। বিজ্ঞানশিক্ষায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত কোনো ছবিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, এই প্রথা লেখক কোথায় পেয়েছেন জানতে পারলে আমি ভীষণ উপকৃত হব।
পরের অভিযোগটি হলো, ‘আলোর তরঙ্গধর্ম বোঝানোর জন্য চিত্র ৩.২ অঙ্কন করা হয়েছে, তা ভারতের কোচিং সেন্টার বাইজুস থেকে নামানো।’
এই চিত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার যে বীজগাণিতিক সমীকরণের মতো করে ভাবা যায়, সেটি দেখানো। প্রথমত এখানে খুব বেশি কল্পনার অবকাশ নেই। এর প্রমাণ হলো অসংখ্য ওয়েবসাইটে কাছাকাছি রকমের ছবির সমাহার যেটি আমি নিচে দিলাম।
আরেকটি অভিযোগ চতুর্থ অধ্যায়ের চিত্র ৪.৪ এসেছে ফাইন আর্ট আমেরিকা ডটকম থেকে। আদতে ফাইন আর্ট আমেরিকা ডটকমের প্রদায়ক সেটি চুরি করেছে সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি লিমিটেড থেকে।
পাঠ্যবইয়ের যে হাতে আঁকা আর অন্য ছবিটি যে আলোকচিত্র এটি পরিষ্কার। দ্বিতীয়ত, একই ধারণার ছবিতে বিভিন্ন বইয়ে অনেক মিল থাকে। ঠিক যেমন মানবদেহের পরিপাকতন্ত্র সব বইয়ে প্রায় একই রকম। উপরন্তু একটি শুদ্ধ ছবিকে রেফারেন্স ধরে আঁকা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
একই রকম শিশুতোষ নকলের আরও অভিযোগ এসেছে চিত্র ৪.৮, ৫.৫, ৯.২ এবং ১২.১৬ নিয়ে। আমি নিচে পাশাপাশি সব ছবি ও লেখকের রেফারেন্সের ছবিও দিলাম।
উপরের তিনটি পার্থক্যের প্রথমটিতে এটি পরিষ্কার যে পাঠ্যবইয়েরটি ভিন্ন একজন শিল্পী ভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে এঁকেছেন। দ্বিতীয়টি পৃথিবীর সব রসায়ন বইয়েই মোটামুটি একই রকম হয়। তৃতীয় ছবির ক্ষেত্রে দুজন পৃথক শিল্পী আলাদাভাবে এঁকেছেন, এটি একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। সর্বশেষ ছবির ক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত, এমনকি ছবির গরু দুটিও জানে তাদের জাত ভিন্ন!
শেষ ছবিটির ব্যাপারে অভিযোগকারী লেখক অনুযোগ করেছেন যে পাঠ্যবইয়ের চিত্রকরেরা বারবার ইলাস্ট্রেশন করেছেন। তিনি জেনে অবাক হবেন যে বাইজুস কোচিং সেন্টারটি নিজেও নাইট্রোজেন চক্রটি আবিষ্কার করেনি। তারাও প্রচলিত ধারণা ও ছবির ‘বারবার ইলাস্ট্রেশন করেছেন’। সেই ষোড়শ শতাব্দীর প্যালিসি থেকে হালের রবিশংকর পর্যন্ত অনেকে বিভিন্নভাবে একটু একটু করে এই চক্রকে পরিণত করেছেন। নবম শ্রেণির জন্য যেহেতু সব খুঁটিনাটি দেখানোর প্রয়োজন নেই, তাই যেকোনো বই খুললে কাছাকাছি ছবি পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগকারী লেখক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কাছে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা চেয়েছেন কি না, এ রকম গুরুতর অভিযোগ করার আগে। যেসব ছবি নকল বলে দাবি করা হচ্ছে, এখন যদি বইয়ের শিল্পীরা সেসব ছবির ইলাস্ট্রেটর আর ইনডিজাইন ফাইল প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন, তাহলে তিনি কি তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন এবং এ ব্যাপারে নিজের বক্তব্য হাজির করবেন? তিনি কি আদৌ একবারও সেই অনুসন্ধান করেছেন?
লেখকের এই লেখা প্রকাশের পরপর সোশ্যাল মিডিয়ার তোলপাড় এবং তার ভিত্তিতে সরকারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তোড়জোড় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একটি স্থায়ী সোশ্যাল মিডিয়ামুখী জনসংযোগ অধিদপ্তর প্রয়োজন। এ জন্য আমি অভিযোগকারী লেখককে ধন্যবাদ জানাই।
ওমর শেহাব নিউইয়র্কের আইবিএম থমাস জে ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টারে একজন তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সসহ একাধিক এজেন্সির অনুদানপ্রাপ্ত গবেষক এবং বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত।