বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি মুহূর্ত সূচনা করেছিল, যা ছিল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের রাস্তায় দৃপ্ত পা ফেলার
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি মুহূর্ত সূচনা করেছিল, যা ছিল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের রাস্তায় দৃপ্ত পা ফেলার

৭ মার্চ: ইতিহাসের মোড় ফেরার দিন

মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের লম্বা সময়প্রবাহে কোনো কোনো বিশেষ ঘটনার দেখা মেলে, যেগুলোর অভিঘাতে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়, নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়, যেগুলো ইতিহাসের গতিপথে পরিবর্তন আনতে পারে, এমনকি তার মোড় ফেরাতেও পারে। ইতিহাসচর্চায় একে সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয় সিনক্রোনিক অথবা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা হিসেবে, যার পূর্ব উদাহরণ পাওয়া কঠিন। একাত্তরের ৭ মার্চ ছিল সে রকম এক ঘটনা-উদ্ভাসিত দিন, যা আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে চালিত করে। 

১ মার্চ থেকে ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে এগোচ্ছিল, ৭ মার্চের পর তাতে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তরুণেরা সমবেত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, অর্থাৎ অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ, এমনকি অস্ত্রের সঙ্গে পরিচয় শুরুর পর্বটি দিয়ে সেই প্রস্তুতির সূচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব নিয়ে লেখা যেকোনো তথ্যনির্ভর বই পড়লে বিষয়টি জানা যায়।

যে ঘটনাটি ৭ মার্চ ঘটেছিল, তা ছিল ঢাকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সেই ভাষণ, যেটি ছিল নানা কারণে বিশিষ্ট। কারণগুলো খতিয়ে দেখলে, একটুখানি ব্যাখ্যা করলে, বোঝা যাবে ভাষণটি যে দেওয়া হবে, সেটি শুনতে লাখ লাখ মানুষ যে রেসকোর্সে জমায়েত হবে এবং যে ভাষণ নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের মনে এমনই উদ্বেগ দেখা দেবে যে বেতারে তার প্রচার বন্ধ করে সারা দেশের মানুষকে এটি শোনা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ তারা নেবে, এটিও যেন অবধারিত ছিল।

পাকিস্তানিরা কোনোকালেই ইতিহাসের ভালো পাঠক ছিল না। অথবা যে ইতিহাস তারা পড়ত, তা ছিল ভুল ইতিহাস। তারা এই দিনের অভিঘাতটি সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা করতে অক্ষম ছিল। 

আমি সেই জনসভার একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতা এবং দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। মাঠে থেকে আমি সেই বিশাল জমায়েতের প্রত্যাশা, আবেগ, রোমাঞ্চ—সবকিছুই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। সকাল থেকেই বস্তুত এসব আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-জীবনের বন্ধুদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম।

আমার মনে হয়েছিল ৭ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু ভাষণটি দেবেন, সেটি যেন ঘটনাপ্রবাহে অবধারিত হয়ে গিয়েছিল। ৭ মার্চ একটা মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিল, যে মুহূর্তটি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথে ধাবিত করেছিল। 

বাংলাদেশের অনৈক্যপীড়িত; গোষ্ঠীস্বার্থে ধাবিত অসহিষ্ণু এবং দ্বন্দ্বমান এই সময়ে জাতিকে এক ঐক্যের বন্ধনে বেঁধে দেওয়া দিনটিকে অর্থাৎ ৭ মার্চকে সেইভাবে দেখা হয়তো সম্ভব নয়, যেভাবে একাত্তরে জাতি দেখেছিল।

কিন্তু দিনটি তো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেগুলো অনুধাবন করা গেলে বর্তমানের অনেক সমস্যা সমাধানের কিছু পথ খুলতে পারে, অন্তত একটা অভিন্ন লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মন দিয়ে শুনলে অথবা পড়লে এবং একাত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে তা স্থাপন করলে বোঝা যাবে, তিনি সেই ঐক্যকেই প্রধান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি এক জাতিরাষ্ট্রের কিছু চারিত্র্যলক্ষণও শনাক্ত করেছিলেন—তিনি জানতেন এই জাতি আগ্রাসী নয়, কিন্তু আগ্রাসনের শিকার হলে ঘুরে দাঁড়াতে জানে।

তিনি সেই ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থাৎ প্রতিরোধের শক্তি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। একাত্তরজুড়ে পাকিস্তানিরা বর্বরতাকে চালু মুদ্রায় পরিণত করেছিল। তারা নিরীহ মানুষকে, নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যা করেছে, কোনো নারী তাদের সামনে নিরাপদ ছিল না।

কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা নিশানা করেছিলেন শত্রুদের যোদ্ধা এবং যুদ্ধবাজদের। যারা নিরস্ত্র ছিল, বিজয় দিবসের সময় দিয়েও, তাদের প্রাণনাশের ব্যাপক আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও, তারা নিরাপদেই তাদের দেশে ফিরতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রতিশোধের যুদ্ধ হলে সেটি সম্ভব হতো না।

জাতি হিসেবে আমাদের এই গৌরবের জায়গাটা একাত্তরের পরে আমরা আর ধরে রাখতে পারিনি। ৭ মার্চকে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে মনে রাখলে, হয়তো আমাদের বর্তমান সময়ের সংঘর্ষ-সংঘাত আর প্রতিশোধের ঘটনাগুলোয় একটা যতি পড়তেও পারত।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শুরুতে ইতিহাসের একটা সংক্ষিপ্তসার তৈরির বিষয় ছিল: তিনি ৭ মার্চ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাতে পরিষ্কার হয়েছে আমাদেরকে অধিকারবঞ্চিত করার এবং শোষণ করার পাকিস্তানি উদ্দেশ্যটি।

অন্যদিকে কেন আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম, তার একটা খতিয়ান। ভাষণের দ্বিতীয় অংশে বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের কিছু করণীয় তুলে ধরেছেন, পাকিস্তানি অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের কী করতে হবে, তারও একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু বর্ধনশীল তালিকা তিনি দিয়েছেন। 

কিন্তু তৃতীয় অংশে এসে তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু এক দূরবিস্তারী কর্মসূচি দিলেন। সেখানে তিনি যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার ডাক দিলেন। এবারের সংগ্রাম যে মুক্তি ও স্বাধীনতার, সেই ঘোষণা দিলেন। অর্থাৎ তিনি আমাদের ইতিহাসটাকে এক চলমান (যাকে ইতিহাসচর্চায় বলা হয় ডায়াক্রোনিক) প্রবাহে স্থাপন করে বুঝিয়ে দিলেন অতীত কীভাবে বর্তমানের ভিত্তি গড়ে দেয় এবং বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে ভবিষ্যৎকে কীভাবে আমাদের মতো করে নেওয়া যায়।

৭ মার্চের ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু অনেক সময় স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন, যা এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। আবার আবেগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ, ক্ষোভের কিছু উচ্চারণ, শত্রুকেও ন্যূনতম সম্মান দেখানোর আমাদের ঐতিহ্য (যেমন ভুট্টো সাহেব) তাঁর ভাষণে ছিল। ভাষাগতভাবে অত্যন্ত সুগ্রন্থিত ভাষণটি যে কাজটি করেছে, তা কমিউনিকেশন বা যোগাযোগের প্রধান উদ্দেশ্য বলে ধরে নেওয়া যায়—শ্রোতার মনের গভীরে অনুরণন তুলে তার মনোযোগ শতভাগ দখল করে নেওয়া। 

১৮ মিনিটের একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ কীভাবে সেই কাজটি করল, তা নিয়ে ভাবতে গেলে দেখা যাবে, মানুষ যা চাইছিল, বঙ্গবন্ধু তার থেকে আলাদা কিছু করেননি—মানুষের মনের কথার প্রতিফলনই তিনি তাঁর বক্তৃতায় ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেভাবে তা করেছেন—দর্শকদের ইতিহাসবোধ, তাদের দ্রোহ-প্রতিরোধ, তাদের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষাকে শতভাগ বুঝে নিজের ভাষায় সেসব প্রকাশ করেছেন এবং তা করেছেন একজন বাগ্মীর সক্ষমতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও কৌশল দিয়ে—তা হয়তো অন্য কারও পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না।

একাত্তরের মার্চে শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল ভাষণটি দেওয়া। এবং তিনি দিয়েছেন সেই মুহূর্তটিতে, যাকে বলা যায় সময় ও ইতিহাসনির্দিষ্ট। ইতিহাসকে এতটা ঘনিষ্ঠভাবে গড়তে পেরেছেন বলেই তিনি এর শক্তিটা নিজের করে নিতে পেরেছিলেন।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মানুষকে জাগিয়েছিল। রেসকোর্সে জড়ো হওয়া মানুষেরা যে রকম উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মুখে শুনে অথবা পরদিন রেডিওতে শুনে সারা দেশের মানুষও তেমনি নতুন আশায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি সেদিন স্বাধীনতার কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা দেননি, দিলে আন্তর্জাতিক পরাশক্তির কয়েকটি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সরাসরি বিপক্ষে দাঁড়াতে পারত।

আমাদের মুক্তির দাবিও সেই গ্রহণযোগ্যতা পেত না। কিন্তু যে যুদ্ধে শিগগিরই আমরা নামব, সেটি যে স্বাধীনতার যুদ্ধ, তার সুস্পষ্ট বার্তা ওই ভাষণে তিনি দিয়েই রেখেছিলেন। ভাষণটির এখনো সেই শক্তি আছে আমাদের জাগানোর—আমাদের অভিন্ন শত্রুগুলোর (যেমন দারিদ্র্য, বৈষম্য, অধিকারহীনতা—এবং যারা এ জন্য দায়ী) বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামার প্রেরণা জোগানোর।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি মুহূর্ত সূচনা করেছিল, যা ছিল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের রাস্তায় দৃপ্ত পা ফেলার। এ রকম একটা মুহূর্ত এখনো তো আমরা চাই। আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার ফারাক ঘোচানোর উপায় ৭ মার্চ আমাদের এখনো দেখিয়ে দিতে পারে। সে জন্য ভাষণটি কখনো পুরোনো হবে না।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ