ইউক্রেন যুদ্ধের যুক্তি ডিম–মুরগি খেতে না পারার কষ্ট ভোলাবে কি?

‘লোকমুখে ওএমএসের চাল দিচ্ছে’ এই কথা শুনে বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে রানীপুকুর গিয়েছিলেন রেজিয়া বেগম। কিন্তু গিয়ে দেখেন আজ দিচ্ছে না, আগামীকাল চাল দেবে। তাই ক্লান্ত হয়ে রোদে ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরছেন তিনি। আফজালপুর, মিঠাপুকুর উপজেলা, রংপুর, ২৬ ফেব্রুয়ারি।
ছবি: মঈনুল ইসলাম

সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল’ বলে পরিচিত। গুগল ট্রান্সলেটরে আনপ্রেডিক্টেবলের বাংলা মানে দেওয়া হয়েছে অনির্দেশ্য, অনিশ্চিত, যার সম্বন্ধে আগে থেকে বলা যায় না। কেতাবি এই অর্থ বাদেও আরেকটি অর্থ করা যায়। বেসামাল। এই বেসামাল শব্দটি বাংলাদেশের বাজারের সঙ্গে একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়।

চাহিদা ও সরবরাহের চিরায়ত ধারণায় বিশ্বের সবখানে বাজার চললেও বাংলাদেশের বাজার হয়তো তার ধার ধারে না। আক্ষরিক নয়, প্রকৃত অর্থেই যেন খোলাবাজার। সিন্ডিকেট আর কারসাজি—এই দুইয়ের দাপট বাজারে মারমার-কাটকাট। মন্ত্রণালয় আছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে, তদারকি সংস্থা আছে, ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার সংস্থাও আছে, আছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা হয়, তা নিশ্চিতের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো সংস্থা। কিন্তু বাজার শেষ বিচারে অসাধু সিন্ডিকেটের হাতেই সমর্পিত।

উৎপাদক, আমদানিকারক, সরবরাহকারী, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতাসহ সবখানেই সিন্ডিকেটের বড় বড় শুঁড় ভোক্তাকে গুঁতো দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। ভোক্তার পকেট ফাঁকা হতে হতে তার যে পকেটটাই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারোরই নজর নেই।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম, ‘চালের জন্য এমন যুদ্ধ আগে দেখি নাই’। খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির (ওএমএস) ট্রাকের সামনে কম মূল্যে চাল কিনতে যাওয়া মানুষের দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা ও দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ির চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। খবরের ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকার বিটাক মোড়ে। প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ট্রাক এলেই চালের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন মানুষ। প্রতিদিনের বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই চাল নিতে চান। ফলে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুল কাদেরের ভাষ্য থেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। তিনি বলেন, ‘চাহিদা বাড়ার কারণে মূলত বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। বাজারে চালের দাম বাড়ায় সব শ্রেণির মানুষই ওএমএসের চাল কিনতে আসছেন। বরাদ্দ সীমিত থাকায় সবাই চাল পাচ্ছেন না।’ বিশৃঙ্খলা, সব শ্রেণির মানুষ ও বরাদ্দ সীমিত—এই তিন ধারণাকে পাশাপাশি জোড়া দিলে দেশের বিশাল অংশের মানুষের (অতিদরিদ্র থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত) জীবনধারণ যে এখন কতটা কষ্টের হয়ে পড়েছে, তার সূত্রটা পাওয়া যায়।

বাজারে এসব পণ্যের ঘাটতি আছে, তা–ও কিন্তু নয়। কিন্তু দাম বাড়ার পেছনে সেই একই যুক্তি—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মহামারি, যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির এসব অর্থনৈতিক সমীকরণ ও যুক্তি মানুষ আর কতটা বোঝে, কতটা মানে? দিন শেষে বাজার করতে গিয়ে অর্ধেক ব্যাগ খালি করে তার যখন ঘরে ফিরতে হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস আর বঞ্চনাবোধই কেবল জমে জমে পাহাড় হয়। নিজেরা না খেয়ে ছেলেমেয়েদের পাতে এক বেলা অন্তত একটা ডিম কিংবা এক টুকরা পাঙাশ মাছও যখন দিতে পারছেন না, মা-বাবার সেই অপারগতার যন্ত্রণা কতটা স্পর্শ করে আপনাদের?

ওএমএসের ট্রাকের সামনের এই দীর্ঘশ্বাসজনক বাস্তবতা যে শুধু চট্টগ্রামের, তা নয়। ঢাকা, কুড়িগ্রাম, খুলনা—দেশের যেখানেই হোক না কেন, এ চিত্রের ব্যতিক্রম নেই কোথাও। কিন্তু কেন এই বাস্তবতা? অর্থনীতির ভাষায় বললে দেশে মূল্যস্ফীতি চলছে। গত বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহতভাবে সইতে হচ্ছে মানুষকে।

মূল্যস্ফীতির সহজ মানে হলো প্রকৃত আয় নাই হয়ে যাওয়া। যে লোকটা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০০ টাকা নিয়ে বাজারে যেতেন, তিনি এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও সেই ১০০ টাকা নিয়েই বাজারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ এক বছরের তঁার আয়, মজুরি, বেতন বাড়েনি কিংবা সামান্যই বেড়েছে। কিন্তু চাল থেকে শুরু করে ডিম-মরিচ সবকিছুর দাম বেড়েই চলেছে। ফলে গত বছরের ১০০ টাকা দিয়ে এ বছর ৫০-৬০ টাকার বেশি বাজার তিনি করতে পারছেন না। ফলে বাজারে তিনি যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যাগের অর্ধেকটাই ফাঁকা পড়ে থাকছে।

কম খেয়ে, কম পরে, নানা ধরনের কাটছাঁট করে, সীমিত সঞ্চয়টাও ভেঙে, এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে ধার করে বেশির ভাগ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগের দুই বছরেও করোনা মহামারির কারণে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তাতেও সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বড় বিপদে পড়েছিলেন। বলা চলে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনের অবর্ণনীয় এই দুর্দশা ক্রমাগত তিন বছর ধরেই চলছে। কিন্তু তাদের এই কষ্ট, এই দুর্দশা লাঘবে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ কি আছে? বরং দফায় দফায় গ্যাস, জ্বালানি, বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির সুনামি আসছে তো আসছেই।

বিদেশি মুদ্রার তহবিল-সংকটে আমদানিনির্ভর পণ্য চাহিদামতো আনা যাচ্ছে না। আবার দেশে যেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর দামও নানা অজুহাতে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। দিনকয়েক পরেই পবিত্র রমজান মাস। সাধারণত রোজার মাসকে এ দেশের অসাধু সিন্ডিকেট লাগামহীন মুনাফা করার সুযোগ হিসেবে নেয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে সিন্ডিকেট তাদের কৌশল পাল্টে ফেলেছে। দু-তিন বছর ধরে রোজার বেশ আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম তাঁরা আকাশে নিয়ে ঠেকাচ্ছেন। মন্ত্রীরা তাই খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, রমজানে নিত্যপণ্য এবং ডিম, মাংসের দাম আর কোনোভাবেই বাড়বে না।

শেষটার শুরু আবার বাজার দিয়েই করা যাক। রোজা শুরুর বেশ আগেই এবার গরিবের প্রোটিন হিসেবে পরিচিত ডিম, ব্রয়লার মুরগি, পাঙাশ, তেলাপিয়া মাছের দাম রেকর্ড ছুঁয়েছে। একই ধাক্কায় অন্যান্য মাছ, মাংসের দামও বেশ খানিকটা করে বেড়েছে। ডিম, মুরগি, মাছ, মাংসের চাহিদার প্রায় সবটাই এখন দেশেই উৎপাদিত হয়।

বাজারে এসব পণ্যের ঘাটতি আছে, তা–ও কিন্তু নয়। কিন্তু দাম বাড়ার পেছনে সেই একই যুক্তি—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মহামারি, যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির এসব অর্থনৈতিক সমীকরণ ও যুক্তি মানুষ আর কতটা বোঝে, কতটা মানে? দিন শেষে বাজার করতে গিয়ে অর্ধেক ব্যাগ খালি করে তার যখন ঘরে ফিরতে হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস আর বঞ্চনাবোধই কেবল জমে জমে পাহাড় হয়। নিজেরা না খেয়ে ছেলেমেয়েদের পাতে এক বেলা অন্তত একটা ডিম কিংবা এক টুকরা পাঙাশ মাছও যখন দিতে পারছেন না, মা-বাবার সেই অপারগতার যন্ত্রণা কতটা স্পর্শ করে আপনাদের?

  • মনোজ দেপ্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী