রোনাল্ড রস মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে দুঃখ করে লিখেছিলেন, ম্যালেরিয়ার কারণ বের করার জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাতে তিনি বিরাট খুশি। তাঁর জীবদ্দশাতেই অনেক মেডেল ও সম্মান তিনি পেয়েছেন, তাতেও তাঁর আনন্দের শেষ নেই। তাঁর একটাই দুঃখ, মশা তাড়ানোর জন্য তিনি যা যা করতে বলেছিলেন, কেউ তার কিছুই করেনি।
ম্যালেরিয়ার মুল্লুকখ্যাত তৎকালীন ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া রোনাল্ড রসের কথামতো কিছু করা হয়নি বলেই এখনো আগরতলা থেকে খাটের তলা—সবখানে মশা আছে। সে কারণেই মশার বিনাশ নেই। সে মৃণ্ময়। সে চিন্ময়। সে অজর, অমর, অক্ষয়। সে অব্যয়! সে মানব, দানব, দেবতার ভয়।
আজ থেকে ঠিক ১২৬ বছর আগে, অর্থাৎ কিনা ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ বের করেছিলেন রোনাল্ড রস। ম্যালেরিয়ার হাত থেকে বাঁচার কায়দা বের করার আনন্দে সেই থেকে এই দিনকে বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে ‘উদ্যাপন’ করা হচ্ছে।
ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমার আনন্দে হাততালি দেওয়া আর ডেঙ্গুর আতঙ্কে হাততালির কায়দায় মশা মারার মধ্য দিয়ে ঢাকায় আমরা এবারের বিশ্ব মশা দিবস উদ্যাপন করছি।
এর আগে চিকুনগুনিয়ার কারণে রাজধানীবাসীর শরীরের প্রতিটি জয়েন্টের প্রতিটি পয়েন্টে ‘অনেক জমানো ব্যথাবেদনা’ চিক্কুর পেড়েছে; এবার ধরেছে ডেঙ্গু। এর মধ্যেই মহান মশা দিবসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ছড়ানো মশা সামলাতেই খাবি খাচ্ছে।
২০১৭ সালে ডিএসসিসির সেই সময়কার মেয়র সাঈদ খোকন ঢাকা দক্ষিণের সাড়ে চার শ কিলোমিটার নর্দমায় গাপ্পি মাছের পোনা ছাড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর কথা ছিল, গাপ্পি মাছ নর্দমা থেকে মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে, তাতে আর মশা হবে না। মশা থাকবে না, তাতে চিকুনগুনিয়াও থাকবে না। তাঁর কথা শুনে নানাজনে হাসাহাসি করেছিল। শেষতক তিনি গাপ্পি প্রকল্প বাদ দিয়েছিলেন। এখন চলছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা। পটাপট মানুষ মরছে।
বছর দুয়েক আগে এডিসের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে উন্নয়নের যোগ থাকার তত্ত্ব হাজির করেছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। তিনি একটি সেমিনারে বলেছিলেন, ‘ডেঙ্গু এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন দেশে ডেঙ্গু এসেছে।’
ধারণা করি, ‘এলিট-অধ্যুষিত’ ঢাকা উত্তর আগের চেয়ে আরও ‘উন্নত হওয়ায়’ সেখানে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য সম্প্রতি ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম একটি বিশেষ পদ্ধতির উদ্বোধন করেছিলেন। মশা মারার এই বিশেষ পদ্ধতি হলো বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) জৈব কীটনাশক প্রয়োগ। সেই কীটনাশক পানিতে দিলে মশার লার্ভা মারা যাবে। ফলে ডেঙ্গু আর হবে না।
কথা ছিল, জৈব কীটনাশক আনা হবে সিঙ্গাপুর থেকে। সিঙ্গাপুরি কোম্পানি বেস্ট কেমিক্যালের এক্সপোর্ট ম্যানেজার পরিচয়ে লি শিয়াং নামের এক বিদেশি লোকও এসেছিলেন। পরে দেখা গেল বেস্ট কেমিক্যাল বলে বসেছে, তাদের সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কারও সঙ্গে কথা হয়নি।
লি শিয়াং নামের কেউ তাদের কোম্পানিতে কাজও করেন না। মানে, সেখানে মশার মতো ক্ষুদ্র একটা ঘাপলা হয়েছে। কেলেঙ্কারির একশেষ হওয়া এ ঘটনায় আতিক সাহেব যথারীতি ‘দেখছি’ বলে চুপ মেরে গেছেন।
ডেঙ্গু কমার যখন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, মশা নিয়ে মশকরায় আমাদের দশা যখন কাহিল, ঠিক তখন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর একটি অভিনব কায়দা বাতলে দিয়েছেন।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তাঁর উদ্যোগ সফল হয়েছে বলে যখন দাবি করছেন, তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ডেঙ্গু রোগীরা জায়গা পাচ্ছে না।
ডেঙ্গু কমার যখন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, মশা নিয়ে মশকরায় আমাদের দশা যখন কাহিল, ঠিক তখন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর একটি অভিনব কায়দা বাতলে দিয়েছেন।
‘পেট ভরে ভাত খেলে খিদে লাগবে না’ টাইপের থিওরি মাথায় রেখে গত মাসে তিনি সুনামগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে বলে এসেছেন, ‘মশা কমলে ডেঙ্গু থাকবে না।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় উজ্জীবিত হয়ে আজকের এই মহান বিশ্ব মশা দিবসের মূল ভাবনা হোক—মশারির মধ্যে বসে হাত ঘষাঘষি না করে মশা কমাতে হবে। আসুন, আমরা আজ থেকে মাছি মারা বাদ দিয়ে ‘মশা মারা কেরানি’ হয়ে যাই।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com