ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বে কেন মডেল

ফিনল্যান্ডে ছয় বছর বয়সে শিশুদের প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তবে সেটি নিতান্তই ঐচ্ছিক। প্রাথমিক স্তরে প্রথম দুটি শ্রেণিতে শুধু মাতৃভাষায় পাঠক্রম পরিচালিত হয়।
ছবি : এএফপি

ফিনল্যান্ডকে বলা হয় একুশ শতকের আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরে ফিনল্যান্ডের সাফল্য এতটাই আলোকোজ্জ্বল যে বিশ্বব্যাপী ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থাকে মডেল বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও ফিনিশরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করতে নারাজ। বরং তারা প্রশংসা ও স্তুতির জগতে ব্যস্ত না থেকে ক্রমাগত আত্মোন্নয়নের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস অতি প্রাচীন। বারো শতকে তৎকালীন চার্চগুলো সমাজসংস্কারের অংশ হিসেবে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। পরবর্তীকালে আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে নানা রাজনৈতিক পালাবদলের মাঝেও ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্ধন ও আধুনিকায়ন জারি থাকে। নর্ডিক দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের গুরুত্ব ও ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ভঙ্গুর আর্থসামাজিক পরিবেশ পুনর্গঠনের বাস্তবতায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফিনল্যান্ডও তাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতে নজর দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে।

ব্যাপকার্থে শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম আধুনিকায়ন করে ১৯২১ সালে প্রণীত হয় ফিনল্যান্ডের সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা আইন। ১৯৭০ সালে ফিনল্যান্ড তাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলে। এ পর্যায়ে তারা ছয় বছর মেয়াদি থেকে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদকালকে পরিবর্তন করে ৯ বছরে নির্ধারণ করে। ২০০৪ সালে তারা কর্মমুখী শিক্ষা আইন সংস্কারে মনোযোগ দেয়। ২০২১ সালে ফিনল্যান্ড বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পরিবর্ধন এবং বিনা মূল্যে তা লাভের সুযোগ চালু করে।

কয়েক দশক ধরেই ফিনল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা, দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিতকরণ এবং জাতিগতভাবে ভালো থাকার মৌলিক উদ্দেশ্যকে নিশ্চিতের লক্ষ্য নিয়ে। ফিনিশরা শিক্ষাকে কেবল জীবিকা নিশ্চিতের একটি মাধ্যম হিসেবে দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা না করে বরং মানুষের আত্মিক ও সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে।

ফলে তাদের শিক্ষাদর্শনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিবর্তে সামগ্রিক জাতিগত উন্নতির গুরুত্ব প্রাধান্য পায়। শিক্ষকের আর্থিক নিশ্চয়তা, সামাজিক মর্যাদা, কর্মক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের প্রশ্নটি তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত কঠোরভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষা মূলত একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষকের কাজ থাকে শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু হৃদয়কে জ্ঞানের আলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকেরা অত্যন্ত স্বাধীনভাবে ও কর্তৃত্বের সঙ্গে তাঁদের নিজ দায়িত্বের সীমা অতিক্রম না করে তা পালন করে থাকেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র নিশ্চিত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।

যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার একটি মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা জরুরি। ফিনল্যান্ড তাদের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান এবং গাণিতিক দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। শতবর্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা আত্মসংস্কার ও জাতিগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। দীর্ঘ মেয়াদে নজর রেখে প্রণীত হয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা কারিকুলাম।

যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের সম্মানবোধ, শিখনের জন্য উপযুক্ত সময় ও আনন্দময় শিক্ষার গুরুত্ব এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের থেকে শিক্ষকের শেখার মতো ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়ও মূল্যায়িত হয়। ফিনল্যান্ডের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ শতকের শুরুতে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ২, ১৮ ও ৮০ শতাংশ ছিল, সেটি একুশ শতকের শুরুতে পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে ৫০, ২৫ ও ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিসংখ্যান প্রমাণ করে ফিনল্যান্ড মাত্র ৮০ বছরের সময়কালে তাদের আর্থসামাজিক স্তরের অভূতপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৬০ সালে দেশটির ১৫ বা তদূর্ধ্ব নাগরিকের মাত্র ১৪ শতাংশ মাধ্যমিক অথবা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিল, যা ২০০৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি স্তর রয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। বাধ্যতামূলকভাবে সাত বছর বয়স থেকে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পিরামিডের আকৃতির এই স্তর বিন্যাসে উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বার ক্রমশ সংকীর্ণ।

ফিনল্যান্ডে ছয় বছর বয়সে শিশুদের প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তবে সেটি নিতান্তই ঐচ্ছিক। প্রাথমিক স্তরে প্রথম দুটি শ্রেণিতে শুধু মাতৃভাষায় পাঠক্রম পরিচালিত হয়। তৃতীয় শ্রেণিতে গিয়ে প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে একই শিক্ষক টানা ছয় বছর পড়ানোর দায়িত্ব পালন করেন, যেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া গড়ে ওঠে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা, দ্বিতীয় কোনো বিদেশি ভাষা, গণিত, পরিবেশ ও বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকতা এবং ব্যবহারিক বিষয়ে পাঠ লাভ করে।

প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের শ্রেণি পরীক্ষার ফলাফল স্কুলগুলো প্রকাশ করে না, বরং সেই ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে। শিক্ষাজীবনের নবম বছরের শেষে ন্যূনতম পাঁচটি বিষয়ে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীরা। ফিনল্যান্ড অত্যন্ত কঠোরভাবে এটি নিশ্চিত করে, যেন দেশটির যেকোনো স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ সমান হয়। এ স্তরের শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যেকোনো প্রতিযোগিতাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করে তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা মূলত বিশেষায়িত শিক্ষার সঙ্গে প্রথম পরিচয় লাভ করে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবনে পঠিত বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও স্কুলের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। উচ্চশিক্ষার স্তরে দুটি ভাগ রয়েছে। পলিটেকনিক ও বিশ্ববিদ্যালয়। অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চাভিলাষী শিক্ষার্থী, যাঁরা শিক্ষকতা কিংবা গবেষণার মতো পেশায় যেতে আগ্রহী, কেবল তাঁরা কঠিন প্রবেশনারি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অন্য শিক্ষার্থীরা পলিটেকনিকে পড়াশোনা শেষ করে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, কোনো শিক্ষার্থী চাইলে প্রাথমিক শিক্ষার পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া না করেও যদি দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তার জন্য কর্মক্ষেত্রের দ্বার উন্মুক্ত থাকে।

সবার জন্য উচ্চমানের ও সমানুপাতিক শিক্ষা নিশ্চিতের উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষাব্যবস্থায় সব শিক্ষকের আর্থসামাজিক মর্যাদা ও দক্ষতা উন্নয়নে সমান গুরুত্ব দেয় ফিনল্যান্ড। দেশটির প্রায় সব শিক্ষকই ন্যূনতম স্নাতকোত্তর পাস এবং প্রত্যেকেই শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশাটিকে সামাজিকভাবে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয় এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষকদের উচ্চ হারে সম্মানী প্রদান করে সরকার। দেশটিতে শিক্ষকতার পেশা শুধু তাঁদের জন্য প্রবেশ সংরক্ষিত, যাঁরা পেশাটির মর্যাদাকে বাস্তবিক অর্থে ধারণ করেন এবং শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে তাঁদের সমস্ত মনোযোগ ব্যয়ে রাজি থাকেন।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষাবিজ্ঞানী ও শিক্ষকেরা পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্বের সঙ্গে স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকার তাঁদের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের বিষয়টি দেখভাল করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে দেশটির ব্যয় তাদের মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকে। পাশাপাশি গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বর্তমানে তাদের ব্যয় জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তারা এ খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে বদ্ধপরিকর। গাণিতিক হিসাবে তখন গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে তাদের বিনিয়োগের অঙ্কটি দাঁড়াবে বার্ষিক ১০ বিলিয়ন ইউরোর চেয়ে বেশি।

বিগত বছরগুলোতে ফিনল্যান্ড তাদের কারিকুলামে অভিবাসীদের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করেছে। জাতিগত ফিনিশদের মতো অভিবাসী ফিনিশ নাগরিকেরাও যেন ন্যায্যতার ভিত্তিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সরকারের যাবতীয় তোড়জোড়।

অভিবাসীদের মধ্যে ফিনল্যান্ডের সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও উদার মনোভাবের বিস্তার ঘটাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোভিডের সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে, সেই সময়ে ফিনল্যান্ড তাদের শিক্ষানীতির একটি আত্মমূল্যায়ন করে, যা থেকে উঠে আসে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিক। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রদেয় পাঠক্রম থেকে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে কঠোরভাবে বাদ দেওয়া, শিক্ষার্থীদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে তাদের যাপিত জীবনের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা এবং সর্বোপরি শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সফলতার কারণ হিসেবে বর্ণিত হয়।

ফিনল্যান্ড মনে করে, শিক্ষা একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই আজীবন শেখার একটি মহাসড়কে সহযাত্রা করে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এ যাত্রা অব্যাহত থাকে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই ব্যাটনের হাতবদল হয়।

বিশ্বে শিক্ষার মান যাচাইয়ের অন্যতম পদ্ধতি পিআইএসএ (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) অনুযায়ী ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের গড় মান নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ভালো হলেও তা সাম্প্রতিক সময়ে নিম্নগামী। দেশটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রেস রিলিজ (৫ ডিসেম্বর ২০২৩) থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওইসিডির (অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা) সদস্যভুক্ত অন্য দেশগুলোর মতো ফিনল্যান্ডের শিক্ষার সামগ্রিক গড় মান নিম্নগামী হয়েছে। সুখবর হলো ফিনিশরা গাণিতিক দক্ষতা, ভাষা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ কিংবা শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক ভারসাম্যহীনতার প্রশ্নে নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকতম সংযোজন হলো ফেনোমেনন বেজড লার্নিং। এটি মূলত শিক্ষার্থীর একান্ত পছন্দ ও আগ্রহের ভিত্তিতে গড়ে তোলা বহুমাত্রিক শিক্ষণপদ্ধতি। এ ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী নিজের প্রাণের আনন্দে নিজের আগ্রহের ইস্যুতে পড়াশোনা, নিরীক্ষণ ও উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করতে পারে। এখানে শিক্ষক কেবল একজন দিকনির্দেশকের ভূমিকায় থাকেন। দেশটির শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটিই আধুনিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ।

শিক্ষা মূলত একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষকের কাজ থাকে শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু হৃদয়কে জ্ঞানের আলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকেরা অত্যন্ত স্বাধীনভাবে ও কর্তৃত্বের সঙ্গে তাঁদের নিজ দায়িত্বের সীমা অতিক্রম না করে তা পালন করে থাকেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র নিশ্চিত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।

অভিভাবক তথা নাগরিকের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করেছে উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড। ফলে মেধাভিত্তিক শ্রমশক্তি উৎপাদন ও জ্ঞান আহরণের একটি মডেলে পরিণত হয়েছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। পদ্ধতিগত আত্মসমালোচনা ও ক্রমাগত উন্নতি লাভের প্রাণান্তকর চেষ্টার দরুন ফিনল্যান্ড আজ উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, যাদের অর্জনে গর্বিত হয়েছে সমগ্র মানবসভ্যতা।

  • কায়সুল খান শিক্ষার্থী ও গবেষক, নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল
    kaisulkhan@pm.me