মতামত

যে লাভের জন্য ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে চায় চীন

‘ইউক্রেন যুদ্ধে একটি মীমাংসিত পরিসমাপ্তির জন্য আরও সময় প্রয়োজন। আর সেটার জন্য বেইজিংয়ের মধ্যস্থতার চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন।’
ছবি : রয়টার্স

এক বছরের বেশি সময় সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর ২৬ এপ্রিল চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তাঁদের এই কথোপকথন সম্পর্কে চীন বলেছে, ‘দুই পক্ষ চীন–ইউক্রেন সম্পর্ক এবং ইউক্রেন সংকট নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছে।’ কিন্তু বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এ বিষয়টিকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বেইজিংয়ের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এরই মধ্যে জেলেনস্কি তাঁর টুইটারে টুইট করে বলেছেন, সি চিনের সঙ্গে দীর্ঘ ও অর্থপূর্ণ ফোনালাপ হয়েছে। পরে জেলেনস্কি তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তাঁদের ফোনালাপে নির্দিষ্ট মনোযোগ পায় ‘ইউক্রেনে একটি একটি ন্যায্য এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে বের করতে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়টি’।
সি চিনের এই ফোনকল থেকে সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে, তা হলো ইউরেশিয়া অঞ্চলের ঘটনাবলিতে চীন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায় এবং ‘ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব পক্ষের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা’ করতে আগ্রহী।

মন্দের ভালো বিষয় হলো, মধ্যস্থতার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে চীন। এ কাজের জন্য বেইজিং যে সময়টা বেছে নিয়েছে, সেটাও সঠিক সময়। এটা এই কারণে যে পশ্চিমা জোটের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়ছে এবং ইউক্রেনীয়দের পাল্টা আক্রমণ অভিযানে সফলতা আসবে কি না, তা নিয়ে তাদের মধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
চীনের এই শান্তি স্থাপন পদক্ষেপকে আরও একভাবে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বদলাতে উৎসাহী বেইজিং। বেইজিং দেখাতে চায় এ কাজে তাদের সক্ষমতা বাড়ছে। কিন্তু চীনের সামনের ঝুঁকিটা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। একটা বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছে গভীর এক নিরাপত্তার প্রশ্ন।

ইউরোপের নেতারা বারবার করে বেইজিংকে দাবি জানিয়ে আসছেন, মস্কোর ওপর তাদের যে প্রভাব, সেটা খাটিয়ে যেন তারা ‘ক্রেমলিনের বোধোদয় ঘটায়’। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর সাম্প্রতিক চীন সফরে সেই কথায় বলে এসেছেন।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল, ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলসহ ইউরোপীয় নেতারাও দ্বিধাহীনভাবে এই মত প্রকাশ করেছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের অবস্থান কী হচ্ছে, সেটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন পরস্পরের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্থিতিশীল ও গঠনমূলক সম্পর্ক দুই পক্ষের স্বার্থের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
চীন–ইইউ সম্পর্ক অবশ্যই চীন ও পশ্চিমের বৃহত্তর সম্পর্কের অংশ। সেই সম্পর্কের বরফ গলারও কিছু লক্ষণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন স্বীকার করেছেন যে ‘পরাশক্তির মধ্যকার যে দ্বন্দ্ব, তা নিরসন করা কঠিন।’ কিন্তু তিনি এ–ও উল্লেখ করেন যে ‘চীন যদি আগ্রহী হয় তাহলে ওয়াশিংটনও এ ক্ষেত্রে তার অংশের ভূমিকা পালন করবে।’

সি–জেলেনস্কি ফোনালাপ ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে সতর্ক ও ভঙ্গুর পদক্ষেপ। এই যুদ্ধ অবসানে আরও কার্যকর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটা পথ তৈরি করছে। প্রাথমিকভাবে উত্তেজনা প্রশমন এবং এরপর ধীর ধীরে একটা বন্দোবস্তের পথ খুলে যেতে পারে।

এই উদ্যোগ চীন ও পশ্চিমের মধ্যকার সব বিরোধপূর্ণ বিষয় সমাধান করবে না। কিন্তু তালিকার সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের সুযোগ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে পশ্চিমের সঙ্গে পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় রাশিয়াকে দরকার চীনের। পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবেন না সি চিন পিং। কিন্তু চীনের এমন এক রাশিয়া প্রয়োজন, যে দেশটি এতটা বেসামাল নয়। এর অর্থ হচ্ছে, চীনের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ অবসান ঘটানো প্রয়োজন।

ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে এনে সি চিন পিং দৃঢ়ভাবে ইউরোপের টেকসই নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অপরিহার্য জামিনদার হয়ে উঠতে পারেন।

বেইজিং তাদের দিক থেকে হিসাব–নিকাশের ক্ষেত্রে ভালো করেই জানে, ইউরোপকে তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য চীনের সহযোগিতা জরুরি। এর মানে এই নয় যে আন্ত–আটলান্টিক নিরাপত্তা সম্পর্ক, যেটা ন্যাটোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, তার গুরুত্ব খর্ব হবে। কিন্তু ইউরোপীয় ব্যবস্থার গতিপথে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং এতে চীনের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমের জন্য যে ঝুঁকি

সন্দেহ থাকার পরও ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটন যদি চীনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং কিয়েভ ও মস্কো তাতে আকৃষ্ট হয় হয়, তাহলে ইউরেশিয়া অঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সামনে বড় সুযোগ তৈরি হবে। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে সামরিক দিক থেকে নিরস্ত্র করতে এবং অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে একঘরে করতে সক্ষম এবং সেটা করতে তারা ইচ্ছুকও, তারপরও পুতিনকে রাজনৈতিকভাবে বোঝাতে সি চিন পিং মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

অন্য কথায়, বেইজিং তাদের দিক থেকে হিসাব–নিকাশের ক্ষেত্রে ভালো করেই জানে, ইউরোপকে তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য চীনের সহযোগিতা জরুরি। এর মানে এই নয় যে আন্ত–আটলান্টিক নিরাপত্তা সম্পর্ক, যেটা ন্যাটোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, তার গুরুত্ব খর্ব হবে। কিন্তু ইউরোপীয় ব্যবস্থার গতিপথে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং এতে চীনের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে একটি মীমাংসিত পরিসমাপ্তির জন্য আরও সময় প্রয়োজন। আর সেটার জন্য বেইজিংয়ের মধ্যস্থতার চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। কিন্তু এমনকি ইউক্রেন সংঘাতেও যদি একটি স্থিতিশীল অস্ত্রবিরতির মতো ঘটনা ঘটেও তাতেও লাভবান হবে চীন। কৃষ্ণসাগরে শস্য চুক্তির মতো অন্তর্বর্তীকালীন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা সেটাকে আরও সম্ভবপর করে তুলতে পারে। বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিরসনে এই চুক্তির মেয়াদ নতুন করে বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীর ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বে চীনের প্রভাব ও নেতৃত্ব আরও পোক্ত করবে।

  • স্টেফান উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ