মতামত

ছেলে ছাত্রলীগ করলে বাবা কেন বিএনপি করতে পারবেন না

প্রথমে খবরটি পড়ে বিশ্বাস করতে পারিনি। বাবা যুবদল বা বিএনপি করেন বলে ছেলে আত্মহত্যা করতে চাইবে, এটা হতে পারে না। ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখেন। সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতে ১৮ বছর হওয়ার আগেও  মা–বাবা সন্তানকে কোনো বিষয়ে চাপ দিতে পারেন না। সেখানে মা–বাবারা যেমন সন্তানের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না। পরিবার থেকে রাষ্ট্র সবক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইচ্ছেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আর আমাদের এখানে চলে জবরদস্তি।  

প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, বিএনপির রোডমার্চে অংশ নেওয়া বাবার ছবি দেখে নীরব ইমন (২২) নামের চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এক ছাত্রলীগ নেতা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের মালিরহাট আলকাজ পণ্ডিত বাড়িতে। ইমন পোমরা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ জহির (৪৫)। তিনি পোমরা ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি। ইমন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পোমরা ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নীরব ইমনও। এ সময় চট্টগ্রাম নগরে অনুষ্ঠিত বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচিতে বাবার অংশ নেওয়ার একটি ছবি ইমনকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠান তাঁর সহকর্মী অন্য এক ছাত্রলীগ নেতা। বিএনপির মিছিলে ইমন বাবার ছবি দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়িতে ছুটে যান এবং এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাগারাগি করেন। একপর্যায়ে বিষ পান করে বসেন তিনি। তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসার পর এখন তিনি ভালো আছেন বলে জানা যাচ্ছে।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইমনের বাবা মোহাম্মদ জহির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছিলাম শহরে। ঘরে কী হয়েছে, জানি না। তবে আমি বিএনপির প্রোগ্রামে এসেছি শুনে ইমন বিষ পান করেছে বলে জেনেছি।’পোমরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ইমনের বাবা সম্পর্কে আমার ফুফাতো ভাই৷ তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকায় আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হতো না। তবে ইমন তাঁর বাবাকে প্রায় সময় বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে আসতে বলতেন। এরপরও তাঁর বাবা বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচিতে যাওয়ায় ক্ষোভে ইমন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জেনেছি।’

বাবা জহির অবশ্য অন্য একটি পত্রিকাকে রাজনীতি নিয়ে ছেলের সঙ্গে মতবিরোধের কথা অস্বীকার করে বলেছেন,  ‘আমি বিএনপি করি বলে ছেলে বিষপান করে আত্মহত্যা করবে বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। এতে নিশ্চয় কারো না কারো ইন্ধন আছে।’
আমরা সর্বান্তকরণে ইমনের সুস্থতা কামনা করি। সেই সঙ্গে সুস্থতা কামনা করি বাংলাদেশের রাজনীতিরও। রাজনীতি কোথায় গেলে বিএনপির রোডমার্চে বাবার ছবি দেখে ছাত্রলীগ করা সন্তান বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালাতে পারেন! ইমন তাঁর সিদ্ধান্তে ছাত্রলীগ করছেন। ইমনের বাবা মোহাম্মদ জহির উদ্দিনও তাঁর সিদ্ধান্তে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছেন।

বাবা বিএনপির রাজনীতি করেন, এটা হয়তো ইমনের প্রধান উদ্বেগের বিষয় নয়। তাঁর উদ্বেগ হলো ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠানো ছবিটি। ছবির সঙ্গে কেউ মন্তব্যও জুড়ে দিতে পারেন বলে তাঁর বাবা আশঙ্কা করছেন। ছবিটি যিনিই পাঠিয়ে থাকুন না কেন, এর মাধ্যমে ইমনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিনি ছাত্রলীগ করলেও তাঁর বাবা ভিন্ন রাজনীতি করেন। ইমন এখন স্থানীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই তিনি আরও বড় পদের প্রত্যাশী। সে ক্ষেত্রে এই ছবি বাধা হতে পারে। সংগঠনের বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে পারেন। এ কারণেই কি ইমন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন?

আমাদের দেশে এক পরিবারে ভিন্ন রাজনীতি করা মানুষের সংখ্যা কম নয়। দুই বড় দলের বড় বড় নেতার ভাই–বোন, মামা–ভাগ্নে, চাচা–ভাতিজা ভিন্ন দল করেন। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে গেছে, এ রকম খবর শোনা যায়নি। বরং একে অপরের পরিবারে সন্তানের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছেন।

আমাদের দেশে এক পরিবারে ভিন্ন রাজনীতি করা মানুষের সংখ্যা কম নয়। দুই বড় দলের বড় বড় নেতার ভাই–বোন, মামা–ভাগ্নে, চাচা–ভাতিজা ভিন্ন দল করেন। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে গেছে, এ রকম খবর শোনা যায়নি। বরং একে অপরের পরিবারে সন্তানের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছেন।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ইমন আত্মহত্যার চেষ্টা করে যেই বার্তা দিলেন, সেটি ভয়াবহ। বাবা বিএনপি করলে, ছেলে আওয়ামী লীগ কিংবা ছেলে বিএনপি করলে বাবা আওয়ামী লীগ করতে পারবেন না।   তাঁরা একে অপরকে নিজ দলের পক্ষে আনার চেষ্টা করতে পারেন।  কিন্তু জবরদস্তি করতে পারেন না।  

পাকিস্তান আমলে অনেক মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেমেয়েরা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। কেউ কেউ নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। এসব নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। এমনকি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রতিষ্ঠিত ইত্তেফাক–এ যেসব সাংবাদিক কাজ করতেন, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন বাম ঘরানার। তিনি তাদের ‘লাল মিয়া’ বললে সম্বোধন করলেও কখনো তাদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করেননি। এমনকি তাদের মতের বিরুদ্ধে লিখতেও বাধ্য করেননি।

স্বাধীনতার পরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সন্তানেরা জাসদের রাজনীতি করতেন। কেউ কেউ গণবাহিনীর সদস্যও হয়েছেন। এ জন্য বাবা সন্তানকে ত্যাজ্য করেছেন কিংবা ছেলে বাবাকে ‘গণশত্রু’ আখ্যা দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছেন, এ রকম উদাহরণ নেই। আবার একই বাবার দুই সন্তানের এক সন্তান ছাত্রলীগ, আরেক সন্তান ছাত্র ইউনিয়ন করলেও পারিবারিক বা সামাজিকভাবে কোনো সমস্যা হয়নি। গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যদি সন্তানকে বাবার দল কিংবা বাবাকে সন্তানের দল করতে বাধ্য করি, তাহলে তো দেশে ভিন্ন দল থাকবে না। ভিন্ন রাজনীতি থাকবে না। ভিন্ন মতও থাকবে না।

স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন যখন নির্দলীয়ভাবে হতো, তখন এক পরিবার থেকেও একাধিক প্রার্থী হতেন। যে যাঁর নির্বাচনী প্রচার চালাতেন। এমনকি স্বামী–স্ত্রী, ভাই–ভাই,বাবা–পুত্র, শ্বশুর–জামাতা, চাচা–ভাতিজাকেও একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা গেছে। স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে দলীয় মার্কা চালু করার পর ঘরে–ঘরে, পাড়ায়–পাড়ায় বিভাজন তৈরি হয়েছে। কেউ কারও মুখ দেখেন না। ভিন্ন দলের সঙ্গে ওঠবসের সম্পর্ক অনেক আগেই চুকে গেছে। এখন নিজ দলের ভিন্ন গ্রুপের নেতা–কর্মীদের মধ্যেও দেখা–সাক্ষাৎ হয় না। তাঁরা আলাদা কর্মসূচি পালন করেন। একে অপরকে শত্রু মনে করেন।

রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। কিন্ত মানবজীবনের সব নয়। রাজনীতির বাইরেও পরিবার ও সমাজ আছে। আছে নিজের জীবনও। কিন্তু আমাদের নেতা–নেত্রীরা রাজনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেখানে ঘরে ঘরে প্রাচীর তৈরি হয়েছে। বাবা ছেলের রাজনীতি মেনে নিতে পারেন না। ছেলেও বাবার রাজনীতিকে সহ্য করতে পারেন না। এ কারণেই বাবার রোডমার্চের ছবি দেখে ছেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন? এ কেমন রাজনীতি!

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি