বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য কি কাটবেই না?

ঘটনা-১
সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে এসে দুই বিচারপতির বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের বিচার চাইল ১৫ বছরের এক কিশোরী। …গত ১৫ জুন নীলফামারীর ওই কিশোরী তার মায়ের সঙ্গে হাইকোর্টে এসে বিচারপতিদের উদ্দেশে বলে, ‘স্যার, আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমরা খুব গরিব। মামলা চালানোর মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।’ আকস্মিক এ ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েন আদালতকক্ষে উপস্থিত বিচারপতি ও আইনজীবীরা।…ওই কিশোরী তার মায়ের সঙ্গে আদালতে আসার কথা জানিয়ে বলে, ‘আমার বয়স ১৫ বছর। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্য আমাকে ধর্ষণ করে। কিন্তু নীলফামারীর আদালত তাকে খালাস দিয়েছেন। আইনি লড়াই চালানোর মতো টাকা আমাদের নেই। আমরা এখন আপনাদের কাছে বিচার চাই।’ (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৫ জুন ২০২২)

ঘটনা-২
থানা, পুলিশ, আদালত ও আইনজীবীর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে নাস্তানাবুদ হয়েছেন তিনি। নিরাপত্তার ভয়ে পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার মেয়ের বিচারের দাবিতে কীভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, তা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক মা আক্ষেপ করে বলেন, ‘গরিব বলে কি আমি বিচার পাব না।’ নেত্রকোনার বাসিন্দা ওই মা ২৫ নভেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব আক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, তাঁর ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েকে তিন বছর আগে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও এখনো বিচার পাননি তিনি। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৫ নভেম্বর ২০২২)

বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, জনস্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে, সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের সুবিধা-অসুবিধাকে আমলে নিতে হবে। শ্রেণি, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে কেউ বিচার পাবেন, আবার কেউ বিচার পাবেন না, বিচারের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না।

ঘটনা-৩
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ২৪ নভেম্বর রাত থেকে ২৫ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুপুরে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার কৃষকদের বরাত দিয়ে ঈশ্বরদী থানা-পুলিশ বলে, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ওই কৃষকেরা। ঋণের টাকা পরিশোধ করার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। …তাঁরা সবাই প্রান্তিক কৃষক। (প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০২২)

ওপরের তিনটি ঘটনা আমাদের দেশে বিচারের একটি প্রতীকী চিত্র। প্রথম দুটি ঘটনায় ভুক্তভোগী ও বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, গরিব বলে তাঁরা বিচার পাচ্ছেন না। শেষ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রান্তিক কৃষক। এ ক্ষেত্রে আদালত ও পুলিশের অতি তৎপর ভূমিকা লক্ষ করা গেছে। এ ঘটনাগুলো থেকে এমন মনে হতে পারে, বিচারপ্রার্থীরা গরিব হলে তাঁদের পক্ষে বিচার পাওয়া দুষ্কর। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রান্তিক বা গরিব হলে তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক সময় ‘অন্যায্য’ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। সুতরাং বিচারের সঙ্গে অর্থ, ক্ষমতা বা প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয়টি স্পষ্ট।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীদের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, ‘আপনারা চুনোপুঁটি ধরছেন। যারা অর্থশালী, ক্ষমতাবান, তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? এদের ধরবে কে?’ (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০২২)। হাইকোর্টের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বিচারের সঙ্গে ক্ষেত্রে অর্থ ও ক্ষমতার সম্পর্কটি বোঝা যায়। বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে শুধু আদালত নন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্য সরকারি সংস্থা ও আইনজীবীরাও যুক্ত থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীকে শনাক্ত করে, গ্রেপ্তার করে, তদন্ত করে আর আইনজীবীরা আদালতে মামলা পরিচালনা করেন। সুষ্ঠু বিচারের জন্য এদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁরা যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করেন কিংবা কোনোভাবে প্রভাবিত হন, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

একটা বিষয় লক্ষণীয়, শুধু বাংলাদেশ নয়, ‍দীর্ঘ সময় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন থাকা যেকোনো দেশের আইনকানুনগুলো সাধারণের জন্য কিছুটা ‘দুর্বোধ্য’ হয়। একইভাবে আদালত বা বিচার বিভাগের সঙ্গেও জনগণের একধরনের ‘দূরত্ব’ থাকে। এর কারণ হলো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের প্রয়োজনে, তাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং তাদের ভাষাতেই আইনগুলো প্রণয়ন করে। আদালত বা বিচার বিভাগও গঠিত হয় একই পদ্ধতিতে।

উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সাধারণের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধান, আইন, বিচার বিভাগের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। বাংলাদেশের আইন, আদালত ও বিচার বিভাগে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উপস্থিতি এখনো প্রবলভাবে দৃশ্যমান। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরও রাষ্ট্রের অন্য সব অঙ্গের মতো বিচার বিভাগ এখনো ‘গণবিচ্ছিন্ন’ রয়ে গেছে। গরিব, ক্ষমতাহীন ও প্রান্তিক মানুষেরা আজও তাই বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় থাকেন।

অন্যায়, অপরাধ বা বঞ্চনা হলে সব নাগরিক বিচার পাবেন, এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা করতে হলে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, জনস্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে, সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের সুবিধা-অসুবিধাকে আমলে নিতে হবে। শ্রেণি, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে কেউ বিচার পাবেন, আবার কেউ বিচার পাবেন না, বিচারের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক