মতামত

পনেরো বছরে কতটা এগোলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে মনেই হবে না, এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ বছর শেষ করে ১৫–তে পা রাখল আজ। মনে হবে অনেক বয়স। ৭৫ একরের এক খণ্ড সবুজায়তন এ ক্যাম্পাস। ৪০০ প্রজাতির বৃক্ষে শোভিত। ২০০৮ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল সরকারি টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজের পরিত্যক্ত ভবনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়, তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। প্রথম দফায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। আমি এবং গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. তাজুল ইসলাম একই দিনে যোগদান করা দুজন প্রথম শিক্ষক। আমরা দুজনেই সরকারি কলেজের চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে এখানে আসি। প্রথম ব্যাচে তিন শ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছিল। শিক্ষার্থী ভর্তির তিন মাস পর শিক্ষক নিয়োগ হয়। ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়।

শূন্য থেকে শুরু হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দাঁড়ায়, আমরা যাঁরা শুরু থেকে আছি, তাঁরা কাছে থেকে দেখলাম। প্রথম উপাচার্য দুই ফুট বাই দুই ফুট ছোট্ট দুটি টেবিল জোড়া দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। এই অবস্থায় জনতা ব্যাংকের পক্ষে উন্নত টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। রিকশাযোগে প্রথম উপাচার্য অফিসে আসতেন। বিষয়টি মন্ত্রণালয় জ্ঞাত হওয়ার পর একটি গাড়ি ভাড়া নেওয়ার কথা বললে উপাচার্য একটি গাড়ি ভাড়া করেন।

টিটি কলেজের ছোট্ট ক্যাম্পাস। দেয়ালে ঘেরা। মাঠের মাঝখানে একটি প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছ। ছিমছাম পরিবেশ। সেই অস্থায়ী ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে হৃদ্যতাপূর্ণ সময় কাটত। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকত। প্রতিদিনই যেন উৎসব। কলেজ কর্তৃপক্ষ সীমাহীন সহায়তা নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথম উপাচার্য ছিলেন ড. এম লুৎফর রহমান। তিনি ছিলেন টিপিক্যাল শিক্ষক। শিক্ষা-গবেষণা ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। যোগ দেওয়ার পরই দেখি, একটি কক্ষে অনেকগুলো ছোট টেবিল। এমনভাবে চেয়ার দেওয়া যে সবাই তার পেছনটা দেখতে পান। শিক্ষকেরা মুখোমুখি বসলে পড়া ব্যাহত হবে, তাই চেয়ার-টেবিল ওই ভাবে দেওয়া হয়েছিল।

অরাজনৈতিক সরকারের নিয়োগ দেওয়া উপাচার্যকে রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত দিতে সময় নেয়নি। মাত্র কয়েক মাস পরই দ্বিতীয় উপাচার্য নিয়োগ পান। বর্তমানে উপাচার্য হাসিবুর রশীদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য।
রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি অনেক পুরোনো। দেশ বিভাগের পর থেকে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদের শেষ বছর ২০০১ সালে ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি দিয়েছিলেন। স্থান নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ—সবই হয়েছিল। ২০০১ সালের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। বিএনপির মেয়াদ শেষ হলে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন রংপুরের মানুষের দাবির মুখে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। রংপুরের সুধীজন বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ গঠন করেছিল। আহ্বায়ক ছিলেন কারমাইকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. রেজাউল হক। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নাম পরিবর্তন করে রাখে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ

শূন্য থেকে শুরু হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দাঁড়ায়, আমরা যাঁরা শুরু থেকে আছি, তাঁরা কাছে থেকে দেখলাম। প্রথম উপাচার্য দুই ফুট বাই দুই ফুট ছোট্ট দুটি টেবিল জোড়া দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। এই অবস্থায় জনতা ব্যাংকের পক্ষে উন্নত টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। রিকশাযোগে প্রথম উপাচার্য অফিসে আসতেন। বিষয়টি মন্ত্রণালয় জ্ঞাত হওয়ার পর একটি গাড়ি ভাড়া নেওয়ার কথা বললে উপাচার্য একটি গাড়ি ভাড়া করেন। যেসব কক্ষে ক্লাস হতো সেগুলোর অবস্থা ছিল জীর্ণ-শীর্ণ। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকার কারণে সেগুলো প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। সেখানে একটি মিলনায়তন ছিল। সেখানে যত ভাঙা আসবাব ছিল ফেলে রাখা হতো। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো বের করে ব্যবহার উপযোগী করে তুলি।
পুরোনো ক্যাম্পাসে ছিল কেবল ‘নেই’ আর ‘নেই’–এর সমাহার। কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিল বন্ধুত্ব। ২০১১ সালে যখন আমরা পুরোনো ক্যাম্পাস ছেড়ে আসি, তখন অনেকে বলতেন ‘ভালো থেকো জীর্ণ ভবন, ভালো থেকো কাঁঠালগাছ’। এখন স্থায়ী ক্যাম্পাসে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, হল, ক্যাফেটেরিয়া, গ্রন্থাগার, উপাচার্যের বাসভবন নির্মিত হয়েছে। আরও কিছু ভবন নির্মাণাধীন। ৬টি বিভাগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও এখন বিভাগের সংখ্যা ২২। ৩০০ শিক্ষার্থী দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন হয়েছে। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বইমেলার আয়োজন করা হয়। মুক্তবুদ্ধিচর্চার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষার সময় দেখা গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একঝাঁক তরুণ শিক্ষক। যাঁদের অনেকেই বিদেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি করে এসেছেন। এ বিশ্ববিদ্যলয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখন বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য অধ্যয়নরত। দেশের সব স্তরের চাকরিতেও আছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। সাবেক উপাচার্যের আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ছিল। করোনাকালে তা বেড়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। বর্তমান উপাচার্য হাসিবুর রশীদের একাগ্রতায় এবং একনিষ্ঠ চেষ্টায় সেশনজট শূন্যে নেমে আসছে। এ বছরই সেশনজট শূন্য হবে বলে আমরা আশা করছি। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান করা হয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার, সেশনজট মুক্ত হবে এবার’। বিশ্ববিদ্যায়ের দলাদলি বন্ধ হয়েছে। শিক্ষা-গবেষণার উত্তম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা আশা করব, এই ধারবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। ই–মেইল: wadudtuhin@gmail.com