মতামত

আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর পেছনে কী কাজ করছে

‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল ২০২৩’-এ অপরাধীকে আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ন বাহিনীকে
‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল ২০২৩’-এ অপরাধীকে আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ন বাহিনীকে

জাতীয় সংসদে ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিল উত্থাপন করা হয়েছে। এটি এমন এক সময়ে করা হলো এবং ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর সদস্যদের হাতে এমন সব ক্ষমতা দেওয়া হলো, যা সাধারণ বিবেচনায় উদ্বেগের বিষয় তো বটেই; এটি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একধরনের পরিকল্পনার ইঙ্গিতও বহন করে। এই ইঙ্গিত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের বিপরীতে দেশে একধরনের ভীতি এবং শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়ারই অংশ বলে বিবেচিত হতে পারে।

সোমবার সংসদে উত্থাপিত ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল ২০২৩’-এ ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করার ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যদের।

প্রস্তাবিত এই বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্যের সামনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করে অবিলম্বে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে এবং ক্ষেত্রমতো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।’

এই বিল পাস হলে ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর সদস্যরা পুলিশের মতো ক্ষমতার অধিকারী হবেন। এই আইনের খসড়া ২০১৭ সালে প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তাতে পুলিশের মতো তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন তা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে তাতে করে কার্যত আনসার বাহিনী পুলিশের সমান্তরাল বাহিনীতে পরিণত হবে। কিন্তু এই আপত্তি এখন আর বিবেচিত হচ্ছে না। ইতিমধ্যে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তাঁদের ক্ষমতা ও স্বার্থের বিবেচনায় সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন (আজকের পত্রিকা)। এই ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে যে সরকার একটি সাহায্যকারী বাহিনীকে (অক্সিলারি ফোর্স) এমন ক্ষমতা প্রদান করল, যা পুলিশের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

আনসার এবং ভিডিপির মোট সদস্যসংখ্যা ৬১ লাখ। তবে এর মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্য। প্রস্তাবিত বিল অনুসারে এই ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্যরা। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আনসার বাহিনী হচ্ছে একটি সাহায্যকারী বাহিনী এবং সব মিলে একে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অক্সিলারি ফোর্স বলা হয়ে থাকে।

কোনো অক্সিলারি ফোর্সকে এই ধরনের ক্ষমতা প্রদানের ঘটনা পাকিস্তানি আমলে একবার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটেছিল একবার। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ বলে যে আইন প্রণয়ন করা হয়, তাতে আনসার বাহিনী বিলোপ করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। রাজাকার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে কার্যক্রম শুরু করলেও ১৯৭১ সালে ৭ সেপ্টেম্বর এই বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আওতায় নিয়ে আসা হয়।

স্বাধীনতার পরে আধা সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। ১৯৭২ সালের ১ মার্চে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে রক্ষীবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু তার কার্যকারিতা ভূতাপেক্ষভাবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বহাল করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সেনাশাসন জারির পর ৯ অক্টোবর জারি করা অধ্যাদেশে রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে এর সদস্যদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়।

২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে আনসার বাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজ শুরু হয়েছে এবং ৪০ জেলায় এই বাহিনীর আলাদা অস্ত্রাগার তৈরির কথাও বলা হয়েছিল। এই ধরনের প্রস্তুতির পেছনে বাহিনীর আধুনিকায়ন যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে সরকার এর জন্য নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না কেন, সেটাই প্রশ্ন। একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনে তাড়াহুড়া করে এই বিল উপস্থাপনের উদ্দেশ্য কী?

এই দুই আধা সামরিক বাহিনী তৈরির প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সব বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম এবং তাঁদের ক্ষমতার ব্যবহারের ইতিহাস বলে যে, স্বাভাবিক আইনের বাইরে ক্ষমতা দেওয়া হলে আধা সামরিক বাহিনীর আচরণ সাধারণ মানুষের জন্য এক ভীতিকর অবস্থার সূচনা করে।

সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা অস্বাভাবিক নয় যে, ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য প্রস্তুতি ইতিমধ্যে আছে। সরকারের এই ধরনের যুক্তি স্বস্তি দেয় না, কারণ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর আচরণ আইনের দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাংলাদেশের এলিট বাহিনী হিসেবে বিবেচিত র‍্যাবের ইতিহাস তার বড় প্রমাণ।

পুলিশের বিরুদ্ধে অহরহই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, কিন্তু সেগুলো তদন্তের যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, তা কোনোভাবেই তাদের নিরস্ত করে না। পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণবিষয়ক আইন ২০১৩ সালে পাস হয়েছে, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল আসেনি। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ব্যবহারের মাত্রাও প্রমাণ করে যে আইনের আশ্রয় তৈরি করা হলে তাতে ক্ষমতাসীনেরাই সুবিধা পান। একটি আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা ও আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হলে কী হতে পারে, সেটি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের বিষয়।

এই আইন একটি বাহিনীকে যেকোনো ব্যক্তিকে তল্লাশি ও আটক করার ক্ষমতা দিচ্ছে, যেকোনো স্থানে সেই বাহিনীকে প্রবেশের অধিকার দিচ্ছে। এই আইন এমন সময় করা হচ্ছে, যখন নির্বাচনের সময় আছে তিন মাসের কম। বাহিনীটিকে এই ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের যে একধরনের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল, তার কিছু দিক সম্পর্কে আমরা অবগত।

২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে আনসার বাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজ শুরু হয়েছে এবং ৪০ জেলায় এই বাহিনীর আলাদা অস্ত্রাগার তৈরির কথাও বলা হয়েছিল। এই ধরনের প্রস্তুতির পেছনে বাহিনীর আধুনিকায়ন যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে সরকার এর জন্য নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না কেন, সেটাই প্রশ্ন। একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনে তাড়াহুড়া করে এই বিল উপস্থাপনের উদ্দেশ্য কী?

নির্বাচনের সময় নির্বাচন কেন্দ্রে এই বাহিনীর উপস্থিতির কথা আমরা জানি। এই বিল উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই বাহিনী সহযোগিতা করেছে। এখন নির্বাচনের আগেই এই বাহিনীর সদস্যদের আটক, তল্লাশি, জব্দ করার মতো ক্ষমতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের কর্মীদেরই কেবল বার্তা দেওয়া হচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে এই বার্তা সাধারণ নাগরিকদের জন্যও।

আইন-আদালতে যা চলছে, তা থেকে ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতা বাড়ানোর এই আইনি প্রক্রিয়াকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা রুজু করা, তাঁদের আটক করার ঘটনা এক দশক ধরে চলছে। কিন্তু এখন যেন তা নতুন গতি পেয়েছে। এক দশক আগের মামলাগুলো অকস্মাৎ সচল হয়েছে এবং সেগুলো ত্বরিতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে আদালতে এখন রাতেও বিচারকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে (ডেইলি স্টার)। মামলার কাজ ত্বরান্বিত করতে পুলিশকে ‘যথাযথ’ সাক্ষ্য দিতে ‘নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছে (বাংলা ট্রিবিউন)।

নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না, এই মর্মে পাঁচ বছর আগে দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)-এ। এই রায় সম্ভবত আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়াবে, কিন্তু নির্বাচনের আগে তার নিষ্পত্তি হবে, এমন আশা না করাই বাস্তবসম্মত।

অকস্মাৎ গতিপ্রাপ্ত এই সব মামলার অধিকাংশই যে ‘গায়েবি মামলা’, এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের মামলার কথা গণমাধ্যমে অসংখ্যবার প্রমাণসহ প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা শাহ আলম কী করে এ বছর আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর হামলা করেন, বোমা নিক্ষেপ করেন, সেটার কোনো ব্যাখ্যা নেই (প্রথম আলো)।

এসব ঘটনা ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীকে নতুন ক্ষমতা দেওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনের আগেই বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ এবং নাগরিকদের সন্ত্রস্ত করে তোলাই উদ্দেশ্য। সেই পরিস্থিতিতে কী ধরনের নির্বাচন হতে পারে, সেটা সবাই বোঝেন; ক্ষমতাসীনেরাও চান নাগরিকেরা যেন তা বুঝতে পারেন, তাই রাখঢাকের পথে সরকার যাচ্ছে না।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট