রাশিয়া ও তালেবানের মধ্যে ‘মরিয়া’ সম্পর্কের কারণ কী

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিরা। ২০১৮ সালে মস্কোতে
ছবি: এএফপি

গত সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানের আংশিক বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর এটিই প্রথম উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চুক্তি। যৌথ ঘোষণাকালে জানানো হয়, রাশিয়া আফগানিস্তানকে গ্যাস, তেল ও গম দেবে। কিন্তু কোনটি কত দামে বিক্রি হবে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ্যে জানানো হয়নি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কীভাবে তেল, গ্যাস ও গম সরবরাহ করা হবে, কীভাবেই–বা লেনদেন হবে, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তালেবান যখন কার্যকর বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং রাশিয়া প্রাচ্যের দেশগুলোয় তাদের তেল-গ্যাস বিক্রির চেষ্টা করে যাচ্ছে, এ প্রেক্ষাপটেই তালেবানের সঙ্গে এ বাণিজ্যচুক্তি হয়েছে। রাশিয়া ও আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্ব হয়তো খুব নগণ্য। কিন্তু রাশিয়া ও তালেবান দুই পক্ষের জন্যই আরও বেশি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সংযুক্তি এখন কূটনৈতিক সম্পদ। এর মধ্য দিয়ে মস্কো ও কাবুল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে পারছে যে তারা একঘরে নয়।

তালেবান প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে ও সম্পর্ক বাড়াতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও ফেডারেল রিজার্ভে গচ্ছিত অর্থ স্থগিত করে দেওয়ায় আফগানিস্তানের ব্যবসার ওপর বিশাল প্রভাব পড়ছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের পর দেশটির অর্থনীতি ২০ থেকে ৩০ ভাগ সংকুচিত হয়েছে। মানবিক সংকটের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর রক্তক্ষয়ী হামলা আফগানিস্তানের মানুষের জীবনমান আরও খারাপ করছে। আসন্ন শীত মোকাবিলায় সে কারণেই তড়িঘড়ি করে তেল ও গ্যাস আমদানি নিশ্চিত করতে চান তালেবান শাসকেরা। জ্বালানির জন্য ইরান, কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে তালেবান আলোচনা চালিয়ে আসছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আফগানিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তুর্কমেনিস্তানের একটি তেল কোম্পানির সঙ্গে ছাড়কৃত মূল্যে জ্বালানি সরবরাহের চুক্তি করেছে। ইরানের সঙ্গেও তারা তেল কেনার একটি চুক্তি করেছে। 

প্রথম দিকে চীনের বিনিয়োগের ব্যাপারে তালেবানের অতি উচ্চ আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বেইজিং এখনো তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে অনিচ্ছুক। পূর্ব তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের সঙ্গে তালেবান সম্পর্ক ছিন্ন করবে কি না, সে ব্যাপারে বেইজিংয়ের সন্দেহ রয়ে গেছে।

রাশিয়ার আশঙ্কা, সাবেক তালেবানের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী যদি একত্র হয়ে আইএসে যুক্ত হয়, তাহলে বড় ধরনের নিরাপত্তা–হুমকি সৃষ্টি হবে। তাতে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব কমবে। আফগানিস্তানে শাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক বৈধতা চায় তালেবান। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বৈরিতার মুখে এখন যে জ্বালানি ও খাদ্য প্রয়োজন, সে সম্পর্কে তারা সজাগ। আফগানিস্তানের ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে তালেবান শাসকদের।

আফগানিস্তানের কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট চেম্বারের সহসভাপতি খান জান আলোকোজাই সম্প্রতি বলেছেন, এখন পর্যন্ত চীন এক পয়সা বিনিয়োগও করেনি। এ পরিস্থিতিতে তালেবান তাদের বাণিজ্যসঙ্গী হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়াকে বেছে নিয়েছে। কেননা, রাশিয়ার বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষে তালেবান নিরপেক্ষ থেকেছে এবং দুই পক্ষকে সংযত থাকতে বলেছে।

ইউক্রেন সংকট নিয়ে খাদে পড়েছে রাশিয়া। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এসব ধাক্কা খুব বেশি কাবু করতে পারেনি রাশিয়ার অর্থনীতি। গত সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে, রাশিয়ার জিডিপি ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমবে। আগের পূর্বাভাসে তারা বলেছিল, জিডিপি কমবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। 

রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলো প্রাচ্যের ক্রেতাদের ছাড়কৃত মূল্যে ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে তেল কিনতে প্রলুব্ধ করছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চীন, ভারত, তুরস্ক ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো মস্কোর কাছ থেকে তেল কিনছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় অনেক দেশই সস্তার তেল খুঁজছে। গত অক্টোবর মাসে তেল উৎপাদন নিয়ে ওপেক প্লাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সৌদি আরব তেল উৎপাদন না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ধারণা জন্মায়, রিয়াদ মস্কোর পক্ষ নিয়েছে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে আংশিক বাণিজ্য চুক্তিতে যাওয়া সত্ত্বেও মস্কো যে তালেবান শাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে চলেছে, বিষয়টা এমন নয়। উজবেকিস্তানের সমরখন্দে গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন সম্মেলনে তালেবানকে ডাকা হয়নি। সম্মেলনে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে আফগানিস্তান আবার কবে তাদের মর্যাদা ফিরে পাবে, তা–ও নিশ্চিত নয়। এর অর্থ হচ্ছে আফগানিস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক নয়।

আফগানিস্তানের অর্থনীতি পুনর্গঠনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, এ সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি সাংহাই কো–অপারেশন সম্মেলনে। কিন্তু আফগানিস্তানের মাটি থেকে উগ্রপন্থা ও সংঘাত আশপাশের দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে কি না, সে বিষয়ে নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বারবার সতর্ক করে আসছেন, আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীর ছদ্মবেশে প্রতিবেশী দেশগুলোয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো গিয়ে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত হতে পারে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) রাশিয়াবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আসছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর কাবুলে রাশিয়া দূতাবাসে হামলা চালায় ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রভিন্স। তালেবান আফগানিস্তানে শাসনক্ষমতা নেওয়ার পর কোনো বিদেশি দূতাবাসে সেটাই ছিল প্রথম হামলা।

রাশিয়ার আশঙ্কা, সাবেক তালেবানের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী যদি একত্র হয়ে আইএসে যুক্ত হয়, তাহলে বড় ধরনের নিরাপত্তা–হুমকি সৃষ্টি হবে। তাতে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব কমবে। আফগানিস্তানে শাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক বৈধতা চায় তালেবান। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বৈরিতার মুখে এখন যে জ্বালানি ও খাদ্য প্রয়োজন, সে সম্পর্কে তারা সজাগ। আফগানিস্তানের ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে তালেবান শাসকদের।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

ক্লাদিয়া সিয়া দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক স্টাডিজের রিসার্চ অ্যানালিস্ট, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সিঙ্গাপুর