তুরস্কে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। একটি হলো আগামী ১৪ মে দেশটিতে জনগণ প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়টি হলো আগামী অক্টোবরে দেশটি প্রজাতন্ত্রের শতবার্ষিকী উদ্যাপন করতে যাচ্ছে।
১৯২৩ সালে সামরিক নেতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তাঁর পূর্বসূরি অটোমান সাম্রাজ্যের ইসলামি আইন ও জাতিগত বৈচিত্র্যকে সরিয়ে দিয়ে তুর্কি জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। তখন থেকে তুরস্কে ইহজাগতিকতাভিত্তিক শাসন চালু ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে ক্ষমতায় এসে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আতাতুর্কের সেই রাজনৈতিক সিলসিলা বা পরম্পরাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন।
এরদোয়ান ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে ২০১৭ সালে সংবিধানে সংশোধনী এনে আইন পাস করেন।
দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার এই ২০ বছর ধরে এরদোয়ান অটোমান আমলের ভাবধারা ও সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা দরকার বলে মনে করেছেন, তা–ই করেছেন। আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদে রূপ দেওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে অটোমানদের মহিমান্বিত করে বানানো জনপ্রিয় ঐতিহাসিক টিভি সিরিজ প্রচার করেছেন।
সেই নিরিখে আগামী নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই ঐতিহাসিক। কেননা এর মাধ্যমেই বোঝা যাবে, আধুনিক তুরস্কের মানুষ কি আতাতুর্কের তুরস্ককে চান নাকি এরদোয়ানের তুরস্ককে চান।
আসন্ন নির্বাচনে যদিও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে চারজন দাঁড়িয়েছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দুজনের মধ্যে। একজন তো জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) নেতা এরদোয়ান। অন্যজন হলেন কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠা করা রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কামাল কিলিচদারোগলু।
এরদোয়ান জনতুষ্টিবাদী ইসলামপন্থীদের আধিপত্য থাকা ‘একটি নতুন তুরস্ক’-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নির্বাচনে জিততে চান। অন্যদিকে কিলিচদারোগলু কিছু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিমার্জন করে আতাতুর্কের ইহজাগতিক মূলবোধের পুনর্জাগরণ ঘটাতে চান।
ক্ষমতায় থাকার প্রথম দশকে আতাতুর্কের ভাবধারার গোষ্ঠীর ভেতরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের সমর্থন পেয়েছিলেন এরদোয়ান। এদের মধ্যে বহু কুর্দি, সংখ্যালঘু উপজাতিদের সদস্যরাও ছিলেন, যাঁরা তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন এবং নিজেদের জাতীয়তার পরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। এর বাইরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের এবং তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত করার পক্ষে থাকা উদারপন্থীদেরও সমর্থন অর্জন করেছিলেন।
২০১৩ সালের মধ্যে এই গ্রুপগুলো রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে আতাতুর্কবাদীদের বজ্রমুষ্ঠিকে শিথিল করে দেয়। তখন আবার এরদোয়ানের সঙ্গে এই সব গোষ্ঠীর পুরোনো দ্বন্দ্ব নতুন করে চাগাড় দেয় এবং তাদের মধ্যকার জোট ভেঙে যায়।
এরদোয়ান নির্দিষ্ট কিছু তুর্কি জাতীয়তাবাদী গ্রুপের সঙ্গে নতুন অংশীদারি গড়ে তোলেন। তিনি তুর্কি রাষ্ট্রের পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গিয়ে কুর্দিদের প্রতি বৈষম্যের নীতি গ্রহণ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় কুর্দিপন্থী দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (এইচডিপি) সাবেক নেতা সালেহাত্তীন দেমিরতা ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কারান্তরীণ আছেন।
২০১৭ সালে এরদোয়ানকে উৎখাতের অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িত থাকার দায়ে যে লাখখানেক লোককে জেলে ঢোকানো হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই এরদোয়ানের সাবেক মিত্র ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারী। এরদোয়ান তাঁদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ ছাড়া অনেক উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীকেও তিনি জেলে পুরেছেন, যা তাঁর জাতীয়তাবাদী অংশীদারদের খুশি করেছে।
জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে এরদোয়ানের এই সাম্প্রতিক জোট গড়ার অর্থ এই নয় যে তিনি আতাতুর্কবাদে দীক্ষিত হয়েছেন; বরং এর মাধ্যমে তিনি জাতীয়তাবাদীদের নিজের মতাদর্শের দিকে টেনেছেন।
২০ বছর ধরে এরদোয়ান যে দমন–পীড়ন করেছেন, তাতে সাধারণ তুর্কিদের একটি বিরাট অংশ তাঁর শাসনের প্রতি বিরক্ত। তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তুরস্কের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। সেখানে মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এর মধ্যে ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ৫০ হাজার লোক মরেছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
এরদোয়ানের দল আরও যে তিনটি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি দল নিয়ে জোট গড়েছে, তাদের সব কটিই নারীর প্রতি সহিংসতারোধের আন্তর্জাতিক চুক্তি (যেটি ইস্তাম্বুল সনদ নামে পরিচিত) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তারা মনে করে, এই সনদে পশ্চিমা তত্ত্ব জুড়ে দিয়ে ‘পারিবারিক মূল্যবোধ’কে হুমকিতে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে সিএইচপি নেতা কামাল কিলিচদারোগলু ও তাঁর জোট উদারপন্থী মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার এবং পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে বন্ধন শক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা কট্টর আতাতুর্কবাদ থেকে বেরিয়ে কিছুটা সংস্কারের পথে হাঁটছে। যেমন তারা ঘোষণা দিয়েছে, তারা জয়ী হলে সরকারি দপ্তরে নারীদের হিজাব পরাকে নিষিদ্ধ করবেন না, যেটি এরদোয়ানের আগে তুরস্কে চালু ছিল।
তবে এরদোয়ান ও কিলিচদারোগলু—উভয়েরই শক্তি ও দুর্বলতা আছে।
আসন্ন নির্বাচনে এরদোয়ান তাঁর দুই দশকে বানানো কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্রের ওপর অনেকটা ভরসা করছেন। তিনি পরিকল্পিতভাবে দেশের সংবাদমাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া দেশটির প্রায় ৮০ হাজার মসজিদের পরিচালনা পর্ষদও তাঁর হয়ে কাজ করবে বলে ধারণা করা হয়। তবে ২০ বছর ধরে তিনি যে দমন–পীড়ন করেছেন, তাতে সাধারণ তুর্কিদের একটি বিরাট অংশ তাঁর শাসনের প্রতি বিরক্ত। তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তুরস্কের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। সেখানে মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এর মধ্যে ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ৫০ হাজার লোক মরেছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে কিলিচদারোগলুর বড় শক্তি হলো তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের ভোট। এর সঙ্গে আছে কুর্দিসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন। আর তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো ২০১০ সাল সিএইচপির নেতা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বহুবার তিনি এরদোয়ানের কাছে ভোটের লড়াইয়ে হেরেছেন। তুর্কি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা রক্ষণশীল মুসলমান। তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে সিএইচপির ইহজাগতিক নীতির বিরোধিতা করে থাকেন।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেত টি কুরু সান দিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক