জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনা গভীরতম আনন্দের এক ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। আর এই আনন্দ বেড়ে যায় মুক্ত হওয়া সেই সব জিম্মির ক্ষেত্রে, যাঁদের আটক থাকাকালীন শারীরিক ও মানসিক অবস্থা থাকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং অবস্থানও থাকে অজানা। কিন্তু আমরা সবাই এটা জানতে পারি যে তাঁরা প্রতিমুহূর্তে চরম বিপদের মধ্যে রয়েছেন, যেমনটা রয়েছেন গাজা উপত্যকার অধিবাসীরা, যাঁরা আট মাস ধরে বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছেন।
মুক্ত হওয়ার পর নোয়া আরগামানির শান্ত চেহারা ও সলজ্জ হাসির ছবিটা তো আমরা যে নিষ্ঠুর বাস্তবতায় বসবাস করছি, তার ঠিক বিপরীত অবস্থা প্রকাশ করে। সে কারণেই তিনি যেন সংহতির এক দৃঢ় প্রত্যয়ের সূচনা করেছেন। এই তরুণী গিয়েছিলেন একটি সংগীতানুষ্ঠান উপভোগ করতে। তাঁর তো অপহৃত হয়ে দিনের পর দিন এক জীবন্ত নরকে বসবাস করার কথা ছিল না। বরং কথা ছিল যে তিনি হাসিখুশিভাবে ও নিরাপদে নিজ বাড়িতে ফিরে যাবেন।
মোটা দাগে বললে, হামাসের হাতে আটক হওয়া জিম্মিদের পরিবারগুলোর অশেষ যন্ত্রণা যে কারও ভেতর, হোক তিনি একজন আরব বা ইহুদি, গভীর এক সংহতিবোধ তৈরি করবে, তাঁর হৃদয়ে সমবেদনা জাগাবে।
কিন্তু চারজন ইসরায়েলি জিম্মির বন্দিদশা থেকে ছুটে আসার ঘটনায় যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা গিয়েছিল, তা দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যত যা–ই হোক, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে যখন এই মুক্তির মূল্য অন্তত ২৭০ জন নিহত ও প্রায় ৭০০ জন আহত হওয়া, তখন কীভাবে খুশি হওয়া সম্ভব? আর এদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
(ইসরায়েল গত শনিবার গাজার নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরে অভিযান চালিয়ে চার জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করে। দুই ঘণ্টার এ অভিযানে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনীও অংশ নেয়। এতে শিশু, অন্যান্য বেসামরিক ব্যক্তিসহ ২৭৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।)
আমার সামনে যখন ২৭০ জন মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে, তখন কীভাবে খুশি হতে হয়, তা না জানার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। যখন নেপথ্য থেকে শত শত আহত মানুষের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ ভেসে আসছে, তখন রাস্তায় নেমে নাচানাচি করতে না পারার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।
টেলিভিশনের পর্দায় (অবশ্য ইসরায়েলি টিভি চ্যানেলগুলোয় নয়) যেসব দৃশ্য দেখেছি, তা আমার চুল খাড়া করে দিয়েছে। শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ, যাঁদের অনেকেই মারা গেছেন আর বাকিরা যন্ত্রণাময় মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে গেছেন।
আমার ও আরও অনেক ইহুদি ও আরবের সমস্যা হলো যে আমরা ‘উভয় দিকে’ আটকে গেছি। একজন ফিলিস্তিনি বা একজন ইসরায়েলি যেই করুন না কেন, তাঁদের যেকোনো অন্যায় আচরণ আমাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই এখন বোধ হয় সময় এসেছে নতুন একটা পর্যায়ে যাওয়ার আর তা হলো, ‘উভয় দিক’ ছেড়ে ‘যেকোনো এক দিকে’ যাওয়া। তাতে অন্যদিকেরটা উপেক্ষা করে শুধু নিজের দিককার বেদনা অনুভব করা যাবে।
আমার নিরুত্তাপ বোধের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। এই পরিস্থিতিতে আমি উল্লাসে মেতে উঠতে পারছি না। সত্যি, কর্তৃপক্ষ কেন যে সব বিদেশি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে শুধু ইসরায়েলি স্টেশনগুলো চালু রাখছে না! টেলিভিশনের পর্দা থেকে যেসব জিনিস দূরে রয়েছে, সেগুলো তো জনসাধারণের হৃদয় থেকেও দূরে থাকছে।
ইসরায়েলে জনগণ আছেন সুরক্ষার মধ্যে। তাঁরা যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকার শুনছেন না বা ওই রকম কোনো দৃশ্য দেখছেন না। তাঁরা শুধু দেখছেন উচ্ছ্বাসের সমারোহ আর দেশপ্রেম।
আমি অবশ্য বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে আমি কি একাই অপর পক্ষের বিয়োগান্তক ঘটনা অবলোকন করছি? আমি কি একাই শত শত নিহত ও আহত মানুষের দৃশ্য দেখছি? আমার অতিমাত্রার সংবেদনশীলতা কি নিহিত আছে আমার ধমনিতে বয়ে চলা ফিলিস্তিনি রক্তে? আমি সত্যি এসব উদ্বেগময় বর্ণনার জন্য বিরক্ত হয়ে পড়া পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাই।
আমার ও আরও অনেক ইহুদি ও আরবের সমস্যা হলো যে আমরা ‘উভয় দিকে’ আটকে গেছি। একজন ফিলিস্তিনি বা একজন ইসরায়েলি যেই করুন না কেন, তাঁদের যেকোনো অন্যায় আচরণ আমাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই এখন বোধ হয় সময় এসেছে নতুন একটা পর্যায়ে যাওয়ার আর তা হলো, ‘উভয় দিক’ ছেড়ে ‘যেকোনো এক দিকে’ যাওয়া। তাতে অন্যদিকেরটা উপেক্ষা করে শুধু নিজের দিককার বেদনা অনুভব করা যাবে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম তো উন্মাদ হয়ে গেছে। তারা এই অভিযানকে বীরোচিত সব অভিধায় সম্বোধন করে চলেছে। বলছে যে এটা ছিল দৃষ্টান্তমূলক, সাহসী, সুপরিমিত ইত্যাদি। প্রথম কথা হলো, যদি এটা সুপরিমিত অভিযানই হয়ে থাক, তাহলে শত শত বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হওয়া উচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, এই অভিযান চারজন জিম্মিকে মুক্ত করলেও বাকি প্রায় ১২০ জনের বন্দিদশাকে আরও পোক্ত করেছে।
ইসরায়েল সব সময় বল প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করে। মাসের পর মাস গড়িয়ে গেল, অথচ বন্দী ও জিম্মি বিনিময়ের প্রস্তাব টেবিলে পড়ে আছে। কারণ, ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর কারণ হলো, যিনি এখানে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এতে তাঁর স্বার্থ নিহিত আছে। তাঁর (রাজনৈতিকভাবে) টিকে থাকা তো যুদ্ধ জারি রাখার সমান্তরালে বইছে।
আর ঈশ্বর না করুন, যদি যুদ্ধের অন্তর্ধান ঘটে, তাহলে তো নেতানিয়াহু নিজেকে ইতিহাসের পাতা থেকে ছিটকে পড়তে দেখবেন! তিনি তো বেঁচে আছেন (এবং খেলে যাচ্ছেন) ঋণ করা সময়ের ওপর। যখন জিম্মি মানুষদের মরদেহ পাওয়া যায়, তখন তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। আর যখন জিম্মি ব্যক্তিরা মুক্ত হয়ে আসেন, তখন তিনি পাগলের মতো হা হা করে ছুটে যান তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে।
এ সবকিছুই খুব স্বচ্ছ এবং একই সঙ্গে উপহাসজনকও বটে। তারপরও লোকজন তাঁকে ঘিরে নাচছে। এই ভয়াবহ নৃত্য বন্ধ করার এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়?
ওডেহ বিশারাত আরব-ইসরায়েলি লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজে প্রকাশিত তাঁর লেখাটির বাংলা রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া