হাতে হাতে স্মার্টফোন, ব্যবহারে কতটা স্মার্ট

আমরা কেউ কেউ যেন মুঠোফোন ব্যবহার করি না, মুঠোফোনই যেন আমাদের ব্যবহার করে
ছবি: সংগৃহীত

বছর কয়েক আগে আমার এক সাবেক সহকর্মী দাবি করতেন, তিনি একজন বিশেষ মানুষ, কেননা তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। আজ তা মনে পড়লে তাঁকে শুধু বিশেষ নয়, অনেক সুখী মানুষ মনে হয়। তাঁর প্রতি মনে একধরনের সূক্ষ্ম ঈর্ষা জাগে।
আপনি জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে যেখানেই থাকুন না কেন, মুঠোফোনের হাত থেকে যেন আপনার রেহাই নেই। আপনার হাতে এক মুঠোফোন থাকলেই যে কেউ সর্বত্র—আপনার কর্মক্ষেত্র, বাসা, রাস্তা, রেস্তোরাঁ, উপাসনালয়, এমনকি আপনার বৈঠকখানা বা বেডরুম পর্যন্ত অক্লেশে ঢুকে পড়তে পারে নিমেষের মধ্যে।

মুঠোফোন আপনার কর্মঘণ্টা এবং কর্মঘণ্টার বাইরের সময়ের পার্থক্য অনেক সময় বিলীন করে দেয়, আপনার অবকাশযাপনের সময় আপনার কর্মক্ষেত্রকে অবকাশযাপনকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। আর আপনি যদি মুঠোফোনের কোনো কল রিসিভ করতে না পারেন, তা যেন ক্ষেত্রবিশেষে এক অপরাধ, তা বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে অপরাধ হিসেবে থাকুক আর নাই বা থাকুক; তা সে আপনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন।

আর মুঠোফোন নম্বর যে ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার, সেই ন্যূনতম সৌজন্যবোধ আমাদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায় না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মী ছাড়া আর কাউকে যে আপনি নম্বরটা দিতে না–ও চাইতে পারেন, এ ভাবনা যেন অচিন্তনীয় বা গর্হিত অপরাধ। আর আপনার নম্বরটা কোনোক্রমে কারও কাছে থাকলেই হলো, তার যখন ইচ্ছা, তিনি আপনাকে কল করতে পারেন। যেন আপনি এবং আপনার মুঠোফোন নম্বর একটি জনসম্পদ এবং জনস্বার্থে নিবেদিত।

আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে এখন ডিজিটালের হাওয়া। কিন্তু আমরা কেউ কেউ যেন মুঠোফোন ব্যবহার করি না, মুঠোফোনই যেন আমাদের ব্যবহার করে। আমাদের অনেকের মুঠোফোনপ্রেম এতই বেশি যে অনেক সময় কাউকে ই-মেইল করার পর আবার মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে বা কল করে বলতে হয়, আপনাকে ই-মেইল করেছি, একটু চেক করবেন, প্লিজ। আর এক নতুন ফ্যাশন হয়েছে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। অনেকে ই–মেইলের নিচে নিজের মূল্যবান হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা লিখে দেন। আপনি যদি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার না করেন বা আপনার নম্বরটি যদি সবার সঙ্গে শেয়ার না করতে চান, তাহলে যেন আপনি সেকেলে বা অপাঙ্‌ক্তেয়।

আর অনেক সময় ফোন ধরতে না পারলে অনেকে এত মনঃক্ষুণ্ন হন যেন ফোন ধরতে না পারলে পৃথিবীর অনেক ক্ষতিবৃদ্ধি হয়ে যেতে পারে। সময়মতো কথা বলতে না পারলে কেউ বিরহে কাতর হতে পারেন, কিন্তু কেউ মারা গিয়েছেন, এমন শোনা যায় না। অল্প কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল পদে কাজ করা মানুষদের ক্ষেত্রে হয়তো তাৎক্ষণিক ফোন ধরতে না পারলে কিছু বড় ক্ষতি হতে পারে। সব মানুষই অতি গুরুত্বপূর্ণ নন বলেই তো কেউ কেউ বিশেষ, সর্বসাধারণ থেকে স্বতন্ত্র। তাই এসব সীমিতসংখ্যক অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য নীতি সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত না–ই হওয়ার কথা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাজে কথা’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়।’ তাই মানুষকে চেনার উপায় হিসেবে তিনি মানুষের বাজে কথা দিয়ে তাকে বিচারের কথা বলেছিলেন। বোধ করি, আজকের যুগে উনি বেঁচে থাকলে বলতেন, মুঠোফোনের ব্যবহার থেকে মানুষের ভদ্রতাজ্ঞান যাচাই করা যায়।

শোনা যায়, নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক মহান বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল যখন তাঁর আবিষ্কৃত ডিনামাইটের ধ্বংসাত্মক অপব্যবহার দেখেন, তখন তিনি তাঁর এই শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন। মনে প্রশ্ন জাগে, মুঠোফোনের আবিষ্কারক তাঁর আবিষ্কারের সময়বিনাশী এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তাগ্রাসী ব্যবহার দেখলে ও রকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতেন কি না।

ফ্রি–স্টাইলে কথা বলা যদি আপনাকে আনন্দ না দেয়, আপনি যদি অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না হন, মুঠোফোনের রিংটোন যদি আপনার কানে মধুর মতো না বাজে, আপনি আপনার মুঠোফোনটি ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন, তাতে হয়তো আপনার জীবনে অতি জরুরি কিছু জিনিস কখনো কখনো আপনি হারাবেন, এমনকি অনেক মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন কিন্তু যা পাবেন, তা–ও হয়তো মূল্যহীন নয়। বর্তমান শতাব্দীর ‘সর্বদা সংযুক্ত’ জীবনে নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করার, পড়াশোনা করার খুবসুরত খুব কম মানুষেরই আছে। তা যদি না–ও পারেন, আপনার যদি সর্বদা সংযুক্ত থাকার প্রয়োজন হয়, হয়তো ফিরে যেতে পারেন সেই বাটনযুক্ত মুঠোফোনের সময়ে। ‘আনস্মার্ট’ সব সময়ই সেকেলে বা পিছিয়ে পড়ে থাকা নয়।

কাজের কথা বা কাজ নিয়ে বাগাড়ম্বর যে দেশে কাজের চেয়ে বেশি মূল্যবান, সে দেশে মুঠোফোন যে অনেক মূল্যবান হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মুঠোফোনের নানা বিড়ম্বনার জন্য মুঠোফোনের চেয়ে হয়তো আমাদের সংস্কৃতিই বেশি দায়ী।

আজকাল পদ্মা সেতুর পর আমাদের একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আর কী কী না করলে আরেকটা পদ্মা সেতু করা যেত! ‘ডায়াবেটিস চিকিৎসার এক বছরের খরচ দিয়ে একাধিক পদ্মা সেতু সম্ভব’—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। হিসাব করে দেখা যেতে পারে, আমরা প্রতিবছর মুঠোফোনে কারণে-অকারণে যত সময় নষ্ট করি, সেই সময়ে আমাদের জাতীয় কর্মঘণ্টার কত ঘণ্টা নষ্ট হয় এবং সময়টা কীভাবে সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ নিয়ে গবেষণা হলে বেশ চমকপ্রদ কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে। ১৮ কোটি বাঙালির মধ্যে অনেকের হাতেই আজকাল মুঠোফোন আছে। এই কোটি কোটি বাঙালির সিংহভাগই মুঠোফোনের নানা রকম আসক্তিতে আছেন। সেই আসক্তিতে যা সময় নষ্ট হয়, তা বোধ করি বলাই বাহুল্য। মুঠোফোনে অতি জরুরি কথোপকথন অনেক সময় এত সময় ধরে চলতে থাকে যে আপনার মনে সংশয় জাগতে পারে, বাংলা অভিধানে ‘জরুরি’ শব্দটার নতুন কোনো অর্থ তৈরি হয়েছে কি না বা আজকাল স্কুল-কলেজে সারাংশ রচনার বিষয়টি আর চর্চা করা হয় কি না।

কাজের কথা বা কাজ নিয়ে বাগাড়ম্বর যে দেশে কাজের চেয়ে বেশি মূল্যবান, সে দেশে মুঠোফোন যে অনেক মূল্যবান হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মুঠোফোনের নানা বিড়ম্বনার জন্য মুঠোফোনের চেয়ে হয়তো আমাদের সংস্কৃতিই বেশি দায়ী। পাশ্চাত্যের অনেক দেশের সঙ্গেই আমাদের দেশের মুঠোফোনের সংস্কৃতির মৌলিক পার্থক্য এটাই হয়তো বা নির্দেশ করবে।

কেউ বলতেই পারেন, আপনার মুঠোফোনটি তো আপনাকে কেউ গছিয়ে দেয় না, আপনি তা গাঁটের পয়সা খরচ করেই কেনেন। আজকের যুগে অনেকের জন্য এই আপাতস্বাধীনতা হয়তো বাস্তবিকভাবে নেই। আপাতদৃষ্টে যে স্বাধীনতা থাকলেও তা কার্যত উপভোগ করা যায় না, তাই বোধ করি একটি বড় পরাধীনতা।

  • মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ; সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়