বেশ কিছুদিন হয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছেন। কোটা নিয়ে ২০১৮ সালে আরও বড় আন্দোলন হয়েছিল এবং সে আন্দোলনের ফলে কোটা নিয়ে একরকম ফয়সালাও হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সম্প্রতি আদালতের একটা রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলন করছেন। তাঁদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা তো অবশ্যই আছে। কারণ, তাঁদের আন্দোলনের ফলে সরকার তাঁদের দাবিটা আগেই মেনে নিয়েছিল। কেন শিক্ষার্থীদের আবার এমন একটা আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরা কেউই কোটা বাতিল করার কথা বলছেন না; বরং কোটা সংস্কারের কথাই বলছেন।
অন্য আরও কোটা থাকলেও সমালোচনা হচ্ছে মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের পরিবারকে যদি সাহায্য করতে হয়, তাহলে সরকার তো অন্য অনেকভাবে সাহায্য করতে পারে এবং নানাভাবে তা করাও হচ্ছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা একটি প্রজন্মের জন্য যৌক্তিক ছিল, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম মানে নাতিপুতিরাও সেই সুবিধা পেয়ে যাবে, তা কোনো বিবেচনায়?
কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন মাঠে সরব, ঠিক তখনই চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের একটি অনুসন্ধানে প্রতিবেদনে আমরা জানতে পারলাম, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন এক যুগ ধরে নিয়মিতভাবে ফাঁস হয়ে আসছে। এখন এই খবর যদি সত্য হয়, তাহলে এর দায়টা কে নেবে?
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন থাকে পড়াশোনা শেষে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে যোগদান করার। তো তাঁদের মধ্যে যেসব মেধাবী প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য চাকরিটি পায়নি তাঁদের দায়ভার কে নেবে? কাউকে না কাউকে তো এর দায়ভার নিতে হবে। জানা গেছে, বিপিএসসির কিছু কর্মকর্তা এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।
এর চেয়েও বড় ভয় ও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে যাঁরা সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁদের নিয়ে। যেই ছেলেমেয়েরা এখন আন্দোলন করছেন, তাঁদের অনেকেই চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেবেন। তাঁদের মধ্যে একধরনের শঙ্কা কাজ করবে, তাঁরা হয়তো মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পাবেন না। ভয়, শঙ্কা ও আশঙ্কা নিয়ে কি মেধার চর্চা করা সম্ভব? তাঁদের মধ্যে সব সময় একটা সংকোচ কাজ করবে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়নি তো?
কোটা আন্দোলন নিয়ে যেমন ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার হচ্ছেন, তেমনি ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোটায়’ সরকারি চাকরি পেয়ে যাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, ছাত্রদের উচিত তাঁদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া। নইলে দেশ ও সমাজের ওপর যে কালো ছায়া নেমে আসবে। সে কালো ছায়া ভেদ করে আলো হয়তো আমাদের সমাজে আর না–ও আসতে পারে।
আমরা ধরেই নিই, যাঁরা বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পান, তাঁরা আসলেই মেধাবী। সেই জায়গা যদি সংকুচিত, কলুষিত হয়ে যায়, তাহলে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবেন?
যারা ফাঁসের সঙ্গে জড়িত; তাদের কারও কি বিচার হবে? এখন তো জানা যাচ্ছে, বিপিএসসির যেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাঁদের অনেক টাকাপয়সা, গাড়ি–বাড়ি হয়ে গেছে। কেউ আবার এলাকায় বড় নেতাও বনে গিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আমরা দেখছি, বিপিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক একজন গাড়িচালক এখন বিশাল ব্যবসায়ী এবং এলাকার জনদরদী নেতা। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে তাঁর নাম এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি অফিসে গাড়িচালকের চাকরি করে কীভাবে তিনি এত বড় ব্যবসায়ী হলেন। এও দেখা যাচ্ছে, তিনি ও তাঁর ছেলে দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
বিপিএসসির প্রশ্নফাঁস নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সরব। কিন্তু এতদিন কি এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না? কেন কেউ এসব নিয়ে এতদিন প্রশ্ন করেনি? সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এতদিন কী করেছে?
এখন এ ঘটনায় যদি কারো বিচার না হয়, তাহলে তো ভবিষ্যতে এমন আরও কাণ্ড হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া বিপিএসসির কর্তাব্যক্তিরা কেন এর জন্য ক্ষমা চাইবেন না? তাঁদের তো অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে আস্থার জায়গাটাও তাঁদের তৈরি করতে হবে।
তাঁদের যদি বিচার না হয়, তাঁরা যদি ভুল স্বীকার না করেন, যদি কৈফিয়ত না দেন তাহলে ধরে নিতে হবে, তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাহলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎটা আসলে কোথায়? এসব ঘটনার কি কখনো কোনো বিচার হবে না? চলতেই থাকবে? তরুণ প্রজন্মকে আর কত অন্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে? তাঁদের আর কতভাবে প্রতারিত হতে হবে?
এমনিতেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বিশাল একটা অংশ আজকাল পড়াশোনা শেষে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে আমরা যে আরও অনেক মেধাবীকে হারাচ্ছি না; এর নিশ্চয়তা কোথায়?
কোটা আন্দোলন নিয়ে যেমন ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার হচ্ছেন, তেমনি ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোটায়’ সরকারি চাকরি পেয়ে যাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, ছাত্রদের উচিত তাঁদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া। নইলে দেশ ও সমাজের ওপর যে কালো ছায়া নেমে আসবে। সে কালো ছায়া ভেদ করে আলো হয়তো আমাদের সমাজে আর না–ও আসতে পারে।
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com