মতামত

অর্ধেক উড়ালসড়ক ঢাকাবাসীকে কী দিল

ঢাকায় উড়ালসড়কের অর্ধেক অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে
ছবি : প্রথম আলো

উড়ালসড়ক এখনো ব্যবহার করা হয়নি। তবে উদ্বোধনের বেশ আগে থেকেই ড্রোন দিয়ে ধারণ করা এই উড়ালসড়কের নানা ভিডিও ইউটিউবে দেখেছি। উদ্বোধনের পর এক টিভি চ্যানেলে দেখলাম ড্রোনসহ একাধিক ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে এই উড়ালসড়ক পাড়ি দেওয়ার প্রতিবেদন। বড়ই দৃষ্টিনন্দন। বিমানবন্দরের কাছ থেকে প্রতিবেদক যে গাড়িটি নিয়ে উঠেছেন, তা দিয়ে ১০–১২ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছানো গেল ইন্দিরা রোডে। ঢাকায় যাঁরা চলাচল করেন, তাঁদের জন্য এটা যেন এক ম্যাজিক, স্বপ্নের মতো।

সমস্যা হলো এর সঙ্গে ঢাকাবাসী গত দুই দিন (রবি ও সোমবার) ধরে অন্য ম্যাজিকও দেখতে শুরু করেছে। ঢাকার জ্যাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে, মানে আরও বেড়ে গেছে। ঢাকায় কোথাও যেতে হলে কত সময় লাগতে পারে, তার হিসাব করার একটি নিয়ম আছে। যাত্রাপথে কটি মোড় বা সিগন্যাল আছে এবং সেখানে কমবেশি কতক্ষণ আটকে থাকতে হতে পারে, সেই হিসাবে সময়ের একটি ধারণা পাওয়া যায়। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বা ভিআইপি মুভমেন্ট থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

যেদিন এই উড়ালসড়ক উদ্বোধন করা হলো (শনিবার), সেদিন এই সাফল্য উদ্‌যাপনে নানা আয়োজন ছিল। যাত্রাপথে সময়ের কোনো হিসাব-নিকাশ সেদিন ঢাকাবাসী মেলাতে পারেনি। পরদিন এই উড়ালসড়ক খুলে দিলে পুরো ঢাকায় এর প্রভাব না পড়লেও কিছুটা স্বস্তি মিলবে, সেই আশা আমাদের অনেকের মনেই ছিল। কিন্তু ফল দেখা যাচ্ছে উল্টো। আগে যেসব মোড়ে ২০ মিনিট আটকে থাকার কথা বিবেচনায় থাকত, এখন সেখানে ১ ঘণ্টাও আটকে থাকতে হচ্ছে। আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেলের স্টেশনে নেমে আমার যে সহকর্মী বাসে কারওয়ান বাজার আসতেন ৩০ মিনিটে, উড়ালসড়ক চালু হওয়ার দ্বিতীয় দিনে তার লাগছে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট।

ট্রাফিক অ্যালার্ট নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে। সেখানে লোকজন তাঁদের রাস্তাঘাটের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। কোনো রাস্তায় ঝামেলা দেখলে তা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন। সেখান থেকে আজ সোমবারের তিনটি মন্তব্য আপনাদের জন্য শেয়ার করছি।

উড়ালসড়কের বনানী অংশের নিচে যানজট

একজন লিখেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর বনানী থেকে কচুক্ষেত হয়ে মিরপুর-১৪ যেতে প্রায় ডাবল সময় লাগছে!

আরেকজন লিখেছেন, উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজার রাস্তায় শুধু জ্যাম দেখি আর কিছু দেখি না।

অপরজন ছবিসহ তাঁর মন্তব্য লিখেছেন। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি মহাখালী ফ্লাইওভারে আটকে আছেন। তাঁর মাথার ওপরে উড়ালসড়ক। তিনি লিখেছেন, ৩০ মিনিটের মতো হবে দ্বিতীয় তলায় এসে বসে আছি! এটা কি তৃতীয় তালার যে এক্সিট মহাখালীতে এসে নেমেছে, তার কারণে সৃষ্ট?

সাধারণ মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সাধারণ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমিও বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলাম। আগে যে গাড়িগুলো ধীরে-সুস্থে শহরে ঢুকত, উড়ালসড়কের ম্যাজিক সেগুলোকে মুহূর্তেই শহরের মধ্যে নামিয়ে দিচ্ছে। এটা এমন একটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে, যা নেওয়ার ক্ষমতা শহরের ভেতরের রাস্তা ও মোড়গুলোর নেই। ঢাকার যানজট এমনিতেই অস্বাভাবিক, নতুন উড়ালসড়ক একে ‘অতি’ অস্বাভাবিক করেছে। মনে প্রশ্ন জেগেছে, অর্ধেক উড়ালসড়কের কারণেই কি এই অবস্থা? পুরোটা চালু হলেই কি আসল সুফল পাওয়া যাবে? কিন্তু সাধারণ জ্ঞান দিয়ে তো এই প্রকৌশলগত বা সড়ক চলাচলের যে বিজ্ঞান, তাকে ব্যাখ্যা করার বা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সুযোগ নেই।

এম সামছুল হক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ। পরিবহন খাত নিয়ে কিছু জানা-বোঝার দরকার হলে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি খুব সহজভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেন। এবারও তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি।

তাঁর কাছে প্রথম প্রশ্ন; ঢাকায় গত দুই দিন ধরে যে অতি অস্বাভাবিক যানজট হচ্ছে, এর সঙ্গে নতুন উড়ালসড়ক চালুর কোনো সম্পর্ক আছে কি? তিনি বললেন, শহরের ভেতরে উড়ালসড়ক কখনো যানজট কমাতে সহায়তা করে না। এটা প্রমাণিত। শহর থেকে বের হতে, অর্থনৈতিক লাইফ লাইন চালু রাখতে ও শহরকে বাইপাস করতে উড়ালসড়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা উড়ালসড়কটি করেছি শহরের মধ্য দিয়ে। আমাদের দরকার ছিল বাইপাস সার্জারি, আমরা করেছি ওপেন হার্ট সার্জারি। ফলে শহরে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। শহরের মধ্য দিয়েই যখন হয়েছে, তখন উচিত ছিল কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, মোড়গুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সে ধরনের অনেক পরামর্শও ছিল, কিন্তু তা মেনে চলা হয়নি।

ঢাকার জ্যাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে

দ্বিতীয় প্রশ্ন: এত বড় একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে এসব নানা দিক বিবেচনায় বাইরে থাকে কীভাবে?

আসলে এটা সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। সরকার যেকোনোভাবেই হোক এটা করতে চেয়েছে। একে আমরা কমপালসিভ ডেভেলপমেন্ট (বাধ্যবাধকতার উন্নয়ন) বলতে পারি। পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। প্রি–ফিজিবিলিটি স্টাডি যেটি হয়েছিল, সেখানে শহরের বাইরে দিয়ে এটি করার পরামর্শ ছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও নানা বিবেচনায় শহরের মধ্য দিয়ে ও রেলের জমি ব্যবহার করে তা করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও শুরুতে যে পরিকল্পনা ছিল, তা বিভিন্ন পর্যায়ে বদল হয়েছে, কাটাছেঁড়া হয়েছে। নতুন নতুন র‌্যাম্প যুক্ত হয়েছে, বলা যায় অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনাদের পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি ছবিতে দেখলাম, যেখানে র‍্যাম্প নেমেছে, তার পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ হাঁটছে। হাঁটাচলার জন্য কোনো ফুটপাতের ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।

তৃতীয় প্রশ্ন: পুরো শেষ না করে উড়ালসড়কটি খুলে দেওয়া কি ঠিক হলো?
আমি মনে করি, পুরোটি শেষ না করে খুলে দেওয়া ঠিক হয়নি। এমন অনেকেই এখন উড়ালসড়কে উঠছেন, যাঁদের গন্তব্য অনেক দূরে এবং মাঝপথে নেমে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এই গাড়িগুলো শহরের মধ্যে সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুরোটা তৈরি হলে এখনকার সমস্যা কিছুটা কাটবে। বাস–ট্রাকসহ অনেক বাহন তখন শহরে না নেমে সরাসরি পার হয়ে যেতে পারবে। আসলে চমক দেখাতে গিয়ে প্রকল্প পুরো শেষ না করে তাড়াহুড়ো করে একটি অংশ খুলে দেওয়ায় সমস্যা বেড়েছে।

সামছুল হকের সঙ্গে কথা বলে কিছু বিষয় পরিষ্কার হলো। উড়ালসড়কের বাকি অংশ আগামী বছরের মাঝামাঝি উদ্বোধন করা হবে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। ফার্মগেটের পর কারওয়ান বাজার হয়ে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত কাজের যে অগ্রগতি গত রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দেখলাম, তাতে এক বছরের মধ্যে কাজটি শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়ে মনে সংশয় জেগেছে। তাঁর কাছে আমার শেষ প্রশ্নটি ছিল, আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ কি পুরো কাজটি শেষ হবে? সামছুল হক বললেন, অসম্ভব।

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

akmzakaria@gmail.com