হে করুণাময়, ডলার-পাচারকারীদের দিলে একটু রহম দাও

হে পরম করুণাময়, হে সবকিছুর নিয়ন্তা, তোমার অসীম করুণা। তোমার দয়া আর দাক্ষিণ্যেই তো আমরা বেঁচে আছি। টিকে আছি। বাংলাদেশ এখনো মহেঞ্জোদারোর মতো পরিত্যক্ত হয়নি, ঢাকা এখনো পানাম নগরের মতো নির্জন ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়েনি।

আমাদের পূর্বপুরুষদের পুণ্যকর্ম, ময়-মুরুব্বির দোয়া, কৃষক-শ্রমিক সাধারণ নিষ্কলুষ মানুষদের অহোরাত্র নিষ্পাপ হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কারণেই হয়তো, আর হয়তো বা নিষ্পাপ শিশুদের মুখের দিকে চেয়ে, আমাদের দেশকে তুমি সব সময় করুণা দান করে এসেছ। ঘনঘোর কোভিড অমানিশাকালে যখন নিউইয়র্কের বাড়িতে বাড়িতে লাশ পড়েছিল, উদ্ধারকর্মীরা কূলকিনারা পাচ্ছিল না; স্পেন ইতালির জনপদগুলোয় যখন নেমে এসেছিল গোরস্থানের নীরবতা আর বিভীষিকা, তখনো এই দেশের মানুষ লড়ে গেছে, টিকে গেছে, এবং মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তা, তোমাকে ধন্যবাদ, এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের মানুষ জয়লাভ করেছে।

হে মহান প্রভু, জগৎসমূহের প্রতিপালক, তোমার লীলা-খেলা বোঝা ভারী ভার। তুমি আমাদের নতুন আরেক পরীক্ষায় ফেলেছ। এক গোলক-ধাঁধা। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। কিন্তু আমাদের ডলার-সংকট আর যায় না।

প্রভু, আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর তো আমরা রাখি না। হে সকল জ্ঞানের উৎস, আমাদের ডলারগুলো যায় কোথায়? আমাদের অর্থমন্ত্রী বাজেটে রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, দেশের ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হে মালিক, বিভিন্ন গবেষণায়, আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় আমরা দেখি, বাংলাদেশ আরও দুটো ক্ষেত্রে পৃথিবীর শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, এক হলো কোটিপতি উৎপাদনে, আরেক হলো, দেশের টাকা বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে।

এই টাকা আমরা দেশে রাখব কী করে? আয়ের উৎস দেখাব কী? আর প্রভু তুমিই বলো, দেশটায় আছে কী? নিরাপত্তা নেই! স্থিতিশীলতা নেই। এক বছর পরে নির্বাচন, কী হয় না হয়। দাবার ছক উল্টে গেলে টাকা তো টাকা, সাড়ে তিন হাত শরীরটার ওপর দিয়ে কী বাঁশডলাটা যাবে, ভাবতে তো পারি না প্রভু।

আর এই সব প্রকাশনা সূত্র এ কথাও বলে যে, নির্বাচনের আগে দেশের ডলার বিদেশে যাওয়ার হার দেড়গুণ বেড়ে যায়।
যদি আমাদের রেমিট্যান্স বেড়ে গিয়ে থাকে, গেছে বলেই খবর, যদি আমাদের রপ্তানি আয় বেড়ে গিয়ে থাকে, বেড়ে গেছে বলেই হিসাবপত্র বলছে, তাহলে আমাদের ডলার-সংকট যায় না কেন?

হে প্রভু, আমাদের মহান জাতীয় সংসদে মহত্তর বাজেটে পাচার হয়ে যাওয়া ডলার ফিরিয়ে আনার বিধান রাখা হয়েছে। হে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক, আমাদের শতকোটিপতিদের মধ্যে একটুখানি দয়া দাও। দাক্ষিণ্য দাও। তাদের সুমতি দাও।
এক. তারা বিদেশে ডলার পাঠানো বন্ধ করুক। দুই. যে অযুত কোটি ডলার তারা পাচার করেছে, তা থেকে কিছু কিছু করে তারা দেশে ফিরিয়ে আনুক।

আমরা জানি, দেশের টাকা দেশে রাখায় অনেক অসুবিধা। প্রথম কথা, এই টাকার আয়ের কোনো বৈধ সূত্র এদের অনেকেই দেখাতে পারবেন না। একটা মার্কেট উঠছে, এক শ দোকান থেকে আমি এক লাখ টাকা করে চাঁদা তুলেছি, এক কোটি টাকা উঠেছে, এটার আয়ের সূত্র আমি কী দেখাব। ১০০ লোককে চাকরি দেব বলে প্রত্যেকের কাছে আমি ১০ লাখ টাকা করে নিয়ে দশ কোটি টাকা আদায় করেছি, এটাকে আমি বৈধ করব কীভাবে? এক শ জন মাদক ব্যবসায়ী প্রতি মাসে আমাকে এক কোটি বা এক শ কোটি টাকা দিয়ে যান, তা আমি রাখব কোথায়?

আমি বনখেকো, বন খেয়েছি, টাকা রেখেছি বালিশে; আমি নদীখেকো, নদী দখল করেছি, বালি খেয়েছি; এক শ কোটি টাকার বালির বস্তা বাঁধে ফেলব বলে পুরোটাই নিজের পেটে চালান দিয়েছি; কোটি কোটি টাকার জিনিস আমদানি করে কর ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢুকিয়ে পুরো দামে বিক্রি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছি; আমি দলের ইউনিয়ন কমিটি, উপজেলা কমিটি, কলেজ কমিটির পদ বিক্রি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছি; আমি করোনা পরীক্ষার নামে গরিব রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরীক্ষা না করেই পজিটিভ নেগেটিভ রিপোর্ট বিক্রি করেছি; আমি এক শ টাকার বালিশ সরকারি প্রকল্পে বিক্রি করেছি ২২ হাজার টাকা করে, সেই বালিশ দোতলায় তোলার জন্য আবার দুই হাজার টাকা করে বিল করেছি; আমি এক লাখ টাকার ওয়েবসাইট বানাতে ১০০ কোটি টাকা কোটেশন দিয়েছি; আমি গ্রেপ্তার না করে টাকা পেয়েছি, গ্রেপ্তার করে টাকা নিয়েছি; হুমকি দিয়ে টাকা নিয়েছি; ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করে দেশ থেকে কেটে পড়েছি; শেয়ার-মার্কেট থেকে কারসাজি করে শত শত কোটি টাকা হাপিস করেছি; হায়-হায় কোম্পানি খুলে অনলাইনে কিংবা অফলাইনে চারগুণ দশ গুণ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষের পকেট কেটে শত শত কোটি টাকা উদরস্থ করেছি।

এই টাকা আমরা দেশে রাখব কী করে? আয়ের উৎস দেখাব কী? আর প্রভু তুমিই বলো, দেশটায় আছে কী? নিরাপত্তা নেই! স্থিতিশীলতা নেই। এক বছর পরে নির্বাচন, কী হয় না হয়। দাবার ছক উল্টে গেলে টাকা তো টাকা, সাড়ে তিন হাত শরীরটার ওপর দিয়ে কী বাঁশডলাটা যাবে, ভাবতে তো পারি না প্রভু। আর এই দেশে কি চিকিৎসা আছে? নাইট লাইফ আছে? ছেলেপুলেরা যে একটু পারসানাল জেট নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করবে, সুযোগটা কোথায়? এই জন্যই তো আমাদের জেটটা রেখেছি দুবাইতে। ওখানে একটা দুটো তিনটা চারটা বাড়ি কিনে রেখেছি। কানাডায় বেগমপাড়া করেছি। সিঙ্গাপুরে বৈকালিক ভ্রমণের জন্য একটা ছোট্ট বাড়ি। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়ি। আর টাকা রাখার জন্য আছে সুইসব্যাংক, পানামা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ। ট্যাক্সের ঝামেলা নেই, দুদকের ভয় নেই, ক্ষমতার দাবা উল্টে গেলেও আমার ভবিষ্যৎ তো নিশ্চিন্ত।

কিন্তু প্রভু, এই কথা যারা বলছেন, মানছি, তাদের যুক্তি অকাট্য; তাঁরা তো দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য কাজ করতে করতে তাদের গলা গেছে বসে, পায়ের জুতার তলা হয়ে গেছে ক্ষয়, রাতে ঘুমটাও তো ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে না। তো এই দেশপ্রেমিকের দলের লোকজনদের মনে, প্রভু, তুমি যদি একটুখানি দয়া দাও, একটুখানি বিবেক দাও, তাহলে তারা যদি তাদের বিদেশে পাঠানো ডলারের পাঁচ ভাগ কি দশ ভাগ দেশে ফিরিয়ে আনেন; না হয় বিদেশি বিনিয়োগ দেখিয়েই আনলেন, আমরা তাদের ফুলের মালা দিয়ে গোলাপজল ছিটিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে বরণ করে নিলাম; তেমনটা কি করা যায় না প্রভু?

প্রভু, ওঁরা ভীষণ দেশপ্রেমিক এবং তোমার প্রতি ওঁদের আস্থা আর নির্ভরতার কোনো কমতি নেই! প্রভু, আমাদের দেশকে তুমি বহুবার করুণা করেছ, বহু বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। এই ডলার-সংকট বিপদ থেকে কেবল তুমিই রক্ষা করতে পারো।
আমাদের ডলার পাচারকারী দেশপ্রেমিকদের হৃদয়ে একটুখানি রহম দাও, একটুখানি সত্যিকারের দেশপ্রেম দাও।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক