‘পুতিনের মগজ’খ্যাত আলেকসান্দর দুগিন বলছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক মেরুকন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা এখন মাল্টি পোলার বা বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।’
‘পুতিনের মগজ’খ্যাত আলেকসান্দর দুগিন বলছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক মেরুকন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা এখন মাল্টি পোলার বা বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।’

মতামত

দুগিনের তত্ত্ব: গাজা ইস্যুতে মুসলিম বিশ্ব কি ঘুরে দাঁড়াবে?

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের রিজ-কার্লটন হোটেলে (এই হোটেলেই ২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের নির্দেশে রাজপরিবারের অনেক প্রভাবশালী ধনকুবের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগে আটক করে রাখা হয়েছিল) গত বছরের ১৪ নভেম্বর ৫৭টি আরব ও মুসলিম দেশের নেতারা একটি সম্মেলনে বসেছিলেন।

সম্মেলনটির নাম ‘জয়েন্ট আরব ইসলামিক এক্সট্রা-অর্ডিনারি সামিট’। না বললেও চলে, বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল এই হোটেলের পরিবেশ ছিল জমকালো। আলোচকদের সামনে ছিল বিশাল বিশাল ফুলের তোড়া। মাথার ওপর চকচকে ঝাড়বাতি। ছিল নানা দেশের হাজার পদের খাবারের রাজকীয় ভোজের আয়োজন।

এই সম্মেলনে আরব নেতারা গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বিভিন্ন আরব ও মুসলিম প্রধান দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে গাজায় বোমা বৃষ্টি চলছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে একের পর এক ভবন ধসে পড়ছিল; মানুষ মরছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ডালিম ফুলের লাল টুকটুকে কলির মত ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত লাশ নিয়ে মায়েরা-বাবারা উন্মাদের মতো বিলাপ করছিলেন।

রিয়াদের ওই জরুরি সম্মেলনে সবাই অন্তত এই বিষয়ে একমত ছিলেন, গাজায় যা চলছে তা অন্যায়। অনেক নেতা এসে বেশ গরম-গরম কথা বললেন।

ইসরায়েলকে মানবতাবিরোধী দেশ বলে শাপশাপান্ত করলেন। কেউ কেউ বললেন, ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা থামাতেই হবে।

এরপর আরব লিগের নেতারা মিটিংয়ে বসেছেন। সেখানেও ইসরায়েলকে হামলা থামাতে বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হামলা থামেনি। বরং বেড়েছে।

এরপর আরব বা মুসলিম বিশ্বে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রায়শই বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু তাঁদের নেতাদের তেমন কোনো সাড়াশব্দ মিলছে না।

নালিশ নিয়ে কার যাওয়ার কথা, আর যায় কে

গাজায় গণহত্যার যে নালিশ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)-এ এই মুসলিম বিশ্বের নেতারা যাবেন বলে আশা করা হচ্ছিল, তাঁদের কাউকে দেখা গেল না। দেখা গেল দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকা আদালতকে বলেছে, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে এবং তা বন্ধে দ্রুত আদালত থেকে ইসরায়েলকে আদেশ দেওয়া হোক।

আরব নেতারা গাজাবাসীর জন্য কিছু না করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার এই নালিশে ‘নৈতিক সমর্থন’ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু গাজার রক্তক্ষরণ তাঁদের কতটা কষ্ট দিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ তাঁরা এ বিষয়ে এখনো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন ‘অতি সাবধানী’ ভঙ্গিতে।

ইসরায়েলের গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে কূটনৈতিক বক্তব্যের ভারসাম্য ঠিক রাখছেন। দুই লাইন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বলে তৃতীয় লাইনে হামাসেরও নিন্দা করছেন।

তবে অনেক আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী মনে করছেন, গাজা ইস্যুতে গোটা আরব, তথা মুসলিম বিশ্বের সামনে এক হওয়ার একটি বিরাট সুযোগ এসেছে।

ইসরায়েলের বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাঁরা আলাদা একটি স্বতন্ত্র শক্তির নিজস্ব বলয় গড়ে তুলতে পারেন। এই সুযোগ তাঁদের নেওয়া উচিত।

দুগিনের বহু মেরুর দুনিয়ার কথা

রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক দার্শনিক ও পশ্চিমাবিরোধী বুদ্ধিজীবী আলেকসান্দর দুগিন সম্প্রতি দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরআইএ নোভোস্তিতে প্রায় তিন হাজার শব্দের একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন। রুশ ভাষায় লেখা নিবন্ধটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে সৌদি ভিত্তিক ম্যাগাজিন আল মাজাল্লা প্রকাশ করেছে।

‘পুতিনের মগজ’খ্যাত আলেকসান্দর দুগিন ‘বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও গাজা যুদ্ধ’ শিরোনামের ওই নিবন্ধে বলেছেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে ‘সরাসরি হুমকিতে ফেলেছে’।

তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিম তার প্রক্সি যোদ্ধা ইসরায়েলকে নিয়ে ইসলামি বিশ্বে আক্রমণ চালাচ্ছে; ফিলিস্তিনি আরবদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। সুতরাং, ইসলামের উঠে দাঁড়ানোর সময় হয়েছে।’

দুগিন অনেক দিন থেকেই ‘ইউনিপোলার বিশ্ব ব্যবস্থা’ বাতিল করে ‘মাল্টি পোলার বিশ্বব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছেন। সেই তত্ত্ব বাস্তবায়নে এখন তিনি মুসলিম বিশ্বকে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

নিবন্ধে দুগিন বলেছেন, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন বিশ্বব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য ছিল। একা আমেরিকা ও তার পশ্চিমা সাঙ্গপাঙ্গরা তখন একচেটিয়া মাতব্বরি করতে পারত না।

দুটি বৃহৎ শক্তি বিশ্ব মোড়লিকে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার এবং সোভিয়েত ব্লক চুরমার হয়ে যাওয়ার পর ‘ইউনিপোলার’ বা এক মেরুকন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থার উত্থান হয়।

গোটা বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের বলয়ের মধ্যে চলে যায়। এভাবেই চলছিল।

কিন্তু এখন বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে নতুন দিকে মোড় নিতে দেখা যাচ্ছে। তিনি বলছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক মেরুকন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা এখন মাল্টি পোলার বা বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।’

দুগিন বলছেন, ‘যতই দিন যাচ্ছে, বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি ততই স্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করছে রাশিয়া, চীন, ইসলামি বিশ্ব, ভারত এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা। এই অংশীদাররা নিজ নিজ স্বতন্ত্র সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছে।’

দুগিন বলছেন, যারা পশ্চিমাদের ‘ইউনিপোলার’ ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে চায় তাদের অনেকে আবার ব্রিকস গ্রুপে মিলিত হয়েছে। ২০২৩ সালের জোহানেসবার্গ সম্মেলনে ব্রিকস তার পরিধি বাড়িয়েছে।

মিসর, ইরান ও সৌদি আরবের মতো ইসলামি বিশ্বের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করতে ইথিওপিয়াকে নিয়েছে।

ব্রিকস-এর এই সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, পশ্চিমা আধিপত্যের এক মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে।

দুগিন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা একচেটিয়াবাদের ধারণাকে যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখতে চায়। কারণ এর মাধ্যমেই তারা এই বিশ্বে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক-এই পাঁচটি ক্ষেত্রে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়।

আমেরিকার খবরদারি শেষ হচ্ছে?

দুগিনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এক মেরুকেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার উদিত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে গাজা যুদ্ধকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করছেন দুগিন। তিনি মনে করছেন, এই যুদ্ধ পুরো বিশ্ব ব্যবস্থার আদলই পাল্টে দিতে পারে।
নিবন্ধে দুগিন বলেছেন, ‘ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে সরাসরি হুমকিতে ফেলেছে’।

দুগিন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো যে এক মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে রেখেছে, তাকে মোকাবিলা করতে রাশিয়া ও চীন আলাদা আলাদা ‘পোল’ বা মেরু সৃষ্টি করছে।

একইভাবে মুসলিম প্রধান সব দেশ মিলে নতুন একটি ইসলামিক ‘পোল’ বা ‘মেরু’ গঠন করার সময় এসে গেছে।

এই উদারবাদবিরোধী দার্শনিক বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি অলরেডি তৈরি হয়ে গেছে। এটি নিশ্চিত, বিশ্ব মোড়লেরা যত চেষ্টা করুন না কেন দীর্ঘদিন ধরে জারি থাকা এক মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা আর ধোপে টিকবে না। এই বিশ্ব হয় বহু মেরুকেন্দ্রীক হবে, নয়তো বিশ্বের অস্তিত্বই থাকবে না।’

ইসরায়েলের হামলায় গাজার সব শেষ

দুগিন বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তা আসলে পশ্চিমের এক মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধেই লড়াই। পশ্চিমা প্রোপাগান্ডার প্রভাবে অনেক মুসলিম দেশ গাজা যুদ্ধের কারণ, লক্ষ্য, এবং যুদ্ধটির প্রকৃতি ধরতে পারছে না। তারা মনে করছে, এটি নেহাতই আঞ্চলিক সংঘাত। কিন্তু এটি মোটেও আঞ্চলিক ব্যাপার নয়। এটি বৈশ্বিক ব্যাপার।

দুগিন মনে করেন, রাশিয়া ইউক্রেনে যে অভিযান চালাচ্ছে, সেটিও মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টিতে ভিন্ন অর্থ হাজির করবে। তাদের বুঝতে হবে, রাশিয়া যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটি শুধুমাত্র রাশিয়ার স্বার্থই পূরণ করবে না; এই যুদ্ধের সঙ্গে উদীয়মান ভূরাজনৈতিক মেরুগুলোর স্বার্থও পরোক্ষভাবে জড়িত।

এই কথাটি সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছে চীন। আর ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে ভালো বুঝেছে ইরান।

আশার কথা, সৌদি আরব, মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো কিছু ইসলামি সমাজে খুব দ্রুতগতিতে ভূরাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ছে।

এ কারণেই সৌদি আরব ও ইরান নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছে এবং তুরস্ক তার সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত নীতি পর্যালোচনা করছে।

দুগিনের তত্ত্বমতে, ইসলামি বিশ্ব যত বেশি নিজেদের একটি ‘মেরু’ হিসেবে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করবে, রাশিয়ার আচরণ ততই পরিষ্কার হবে।

একটি যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধে গড়াতে হলে প্রথমেই যেটি দরকার, সেটি হলো বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে জমে থাকা এমন কিছু ইস্যু থাকতে হয় যার সমাধান সামরিক উপায় ছাড়া আর কোনো পথে অর্জন করা সম্ভব হয় না। চলমান গাজা যুদ্ধে এই শর্ত পূরণ হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ?

গাজা পরিস্থিতি কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে? এর জবাবে দুগিন বলছেন, সম্ভবত হ্যাঁ। তিনি বলছেন, বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে অলরেডি বিশ্ব চলে গেছে।

তাঁর মতে, একটি যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধে গড়াতে হলে প্রথমেই যেটি দরকার, সেটি হলো বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে জমে থাকা এমন কিছু ইস্যু থাকতে হয় যার সমাধান সামরিক উপায় ছাড়া আর কোনো পথে অর্জন করা সম্ভব হয় না। চলমান গাজা যুদ্ধে এই শর্ত পূরণ হয়েছে।

যেহেতু ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত ইসরায়েল থামবে না—এ কথা নিশ্চিত; সেহেতু আধিপত্য নিয়ে মুসলিম ও পশ্চিমাদের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে সংঘাত বেঁধে যেতে পারে।

যেহেতু ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত ইসরায়েল থামবে না—এ কথা নিশ্চিত; সেহেতু আধিপত্য নিয়ে মুসলিম ও পশ্চিমাদের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে সংঘাত বেঁধে যেতে পারে

এ অবস্থায় ইসলামি বিশ্বের মিত্রও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামি বিশ্বের প্রথম মিত্র হলো রাশিয়া। দ্বিতীয় হলো চীন, যে কিনা নিজেই তার তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের কাছাকাছি চলে এসেছে। ধীরে ধীরে ইসলামি বিশ্বের সামনে আরও দরজা খুলে যাবে।

পশ্চিমারা স্বেচ্ছায় তার আধিপত্য ত্যাগ করতে চায় না। অন্যদিকে, নতুন স্বাধীনচেতা উদীয়মান বলয়গুলো পশ্চিমের একক আধিপত্যকে আর মুখ বুঁজে সহ্য করতে রাজি নয়। এর বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমি মিত্ররা মানবতার নেতা হতে যে সম্পূর্ণ অক্ষম তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংঘাত বা সমস্যা যে উপশম করতে ব্যর্থ হয় তা সবাই জেনে গেছে।

দুগিন বলছেন, পশ্চিম এবং ইসলামের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের ক্ষেত্রে বাইডেন ও ট্রাম্পের নীতির মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই।

পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যে আসন্ন যুদ্ধে ট্রাম্পের কাছে নমনীয়তা আশা করা ঠিক হবে না

ট্রাম্প নাকি বাইডেন ভালো?

বাইডেন একজন সর্বজন পরিচিত বিশ্বায়নবাদী, একজন উন্মাদ পর্যায়ের রাশিয়া-বিদ্বেষী এবং একমেরুকেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থার চরম সমর্থক। আর ট্রাম্পের অবস্থান আরও জটিল।

ট্রাম্প হলেন, একেবারে নির্জলা ও ধ্রুপদি জাতীয়তাবাদী। তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার স্বার্থ আগে নিশ্চিত করা। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনায় তার পোষায় না। রাশিয়ার বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। তার চেয়ে বরং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা নিয়ে তিনি বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন।

কিন্তু একই সঙ্গে ট্রাম্প আমেরিকায় ইহুদিবাদী লবির পূর্ণ আশীর্বাদপুষ্ট অবস্থায় আছেন। আর সে কারণেই দুগিন মনে করেন, পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যে আসন্ন যুদ্ধে ট্রাম্পের কাছে নমনীয়তা আশা করা ঠিক হবে না।

ট্রাম্প যদি হোয়াইট হাউসে ফেরেন, তাহলে ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। সেটি রাশিয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ট্রাম্প মুসলমানদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে উদাসীন হবেন না। তিনি তাদের প্রতি বরং কঠোর নীতি অনুসরণ করবেন। সম্ভবত বাইডেনের চেয়েও কঠোর হবেন।

এই যুক্তি দেখিয়ে দুগিন বলছেন, ‘আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে এবং একটি গুরুতর ও কঠিন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে হবে।’

দুগিন বলছেন, ‘এটি অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, গাজা যুদ্ধ একটি ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে আরেকটি ধর্মের অনুসারীদের সংঘাত নয়। বরং এটি সমস্ত প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিক, বস্তুবাদী পশ্চিমের যুদ্ধ। যার মানে হলো, খুব সম্ভবত চূড়ান্ত যুদ্ধের সময় এসে গেছে।’

দুগিন বলছেন, এ কারণে অন্যদের মতো আরব বিশ্বকেও একটি বলয় কিংবা ‘মেরু’ গড়ে তুলতে হবে। ইউক্রেনে জয়লাভ করে রাশিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সার্বভৌম মেরুতে পরিণত হবে।

চীন-তাইওয়ানের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সার্বভৌম মেরু হবে। আর ইসলামি বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইনসাফের ওপর জোর দিয়ে এবং ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের ইস্যু সামনে এনে তাদের নিজস্ব মেরুকে সার্বভৌম করতে পারে।

দুগিন মনে করেন, তারপর ভারত, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার পালা আসবে। তারাও পশ্চিমের নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে আরও প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। বহু মেরুকন্দ্রীক বিশ্বের সমস্ত মেরু বা বলয় তাদের নিজ নিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে বাধ্য হবে। এর মধ্য দিয়েই আমরা একটি বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় পৌঁছাতে পারব।

কিন্তু কথা হচ্ছে, দুগিন যে আরব বিশ্বকে পশ্চিমের একচেটিয়া খবরদারিকে মোকাবিলা করতে এক হতে এবং নিজেদের একটি অক্ষশক্তি গড়তে বলছেন, তারা বাস্তবে কতটা তা হতে পারছে। দুগিন নিজে এ বিষয়ে বেশ আশাবাদী। তিনি মনে করছেন, ইতিমধ্যে সৌদিসহ বেশ কিছু দেশ পশ্চিমাদের থেকে নিজেদের সরিয়ে আনছে।

আরব বিশ্ব এক হতে পারবে?

কিন্তু বাস্তবতা দুগিনের সে কথায় সায় দেয় না।

আরব বিশ্বের দেশগুলোতে যে বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা গদিতে বসে আছেন, তাঁদের প্রায় সবাই স্বৈরাচারী ঘরানার শাসক। তাঁরা নিজেরা ভালো করে জানেন, পশ্চিমের ইউনিপোলার বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গেলে ফের পশ্চিমারা ‘আরব বসন্ত’ ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে তাঁরা মাল্টি পোলার ব্যবস্থায় এত শিগগিরই মাথা দেবেন না।

আরব দেশগুলো শপথ করেছিল, ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না। সেই শপথের পিঠে ছুরি মেরে ২০২০ সালের আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।

পরে মরক্কো তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। গাজায় হামাসের হামলা সেই প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছে।

দুগিন গাজা ইস্যুতে আরব বিশ্বকে এক হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছেন। কিন্তু গাজার মানুষের প্রতি সহমর্মী হতে যে মানবিক দরদ থাকা দরকার তা তো আরবদের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনেই দেখা যাচ্ছে না।

সৌদি আরবের পাশের দেশ ইয়েমেনের অপুষ্টি আক্রান্ত শিশুর ছবি এবং গাজায় না খেয়ে থাকা শিশুর খবর যে সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, সেই একই সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরবের মানুষ প্রতি বছর এক শ ৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট করে।


তাঁরা জাতিসংঘের ফুড ওয়েস্ট প্রোগ্রামের হিসাব অনুযায়ী, তারা খেতে বসে প্লেটে খাবার নিয়েও এই পরিমাণ খাবার না খেয়ে ফেলে দেন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে খাবার টেবিল থেকে যত খাবার আবর্জনার বাক্সে ফেলা হয়, তার অর্ধেকই সৌদি আরবের মানুষ ফেলে দিয়ে থাকে।

সৌদি আরবের মানুষ প্রতি বছর এক শ ৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট করে

আরব তথা মুসলিম বিশ্বের এক হওয়া প্রসঙ্গে সৌদি আরবের মানুষের খাবার নষ্ট করার প্রসঙ্গকে কেউ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে করতে পারেন।

কিন্তু নিবিড়ভাবে চিন্তা করুন, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ খাবার না খেয়ে স্রেফ বিলাসিতা করে অযথাই ফেলে দিচ্ছেন অথচ তিনি জানেন, তার প্রতিবেশী না খেয়ে আছে।

সেই অপচয়কারী তার দরিদ্র স্বজাতি কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং একই সঙ্গে একই ছাতার তলায় এক হবে, তা আশা করব কী করে?

আলেকসান্দর দুগিন বলেছেন, মুসলিম বিশ্বকে আলাদা বলয় তৈরি করতে হবে। কিন্তু রিয়াদের রিজ–কার্লটন হোটেলে আরব নেতাদের বিলাসি সম্মেলন আর সৌদি নাগরিকদের এক শ ৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট করার খবর কি সেই বলয় তৈরির স্বপ্নের স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয়?

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com