উত্তরের কথন

'হামার বাড়িত আগুন দেইল ক্যা?'

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ভীতি ও আতঙ্ক কাটেনি
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ভীতি ও আতঙ্ক কাটেনি

রংপুরের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামটি এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এই আতঙ্ক শুধু যে ওই পাড়ায় সীমাবদ্ধ তা নয়; বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বত্র এই ভীতি ছড়িয়েছে। রংপুরের হরকলি ঠাকুরপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে ১০ নভেম্বর হামলা-অগ্নিসংযোগ করা হয়। এখনো তাদের মধ্যে সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ঘটনা ভীতির সঞ্চার করছে। গত সোমবার দুপুরে যখন হরকলি ঠাকুরপাড়ায় গেলাম, তখনো ঘরবাড়ি পোড়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সেখানে অনেক মানুষের সমাগম। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দেখতে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সংখ্যাই বেশি। ওই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা এবং অন্যান্য এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের ভীতি ও আতঙ্কের বিষয়টি টের পেলাম। হরকলির পার্শ্ববর্তী পাগলাপীর নামক স্থান থেকে এসেছেন স্বপ্না রানী রায়। তিনি বলছিলেন, ‘বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে ঘুমাইতে পারছে না। বাচ্চারা বারেবারে জাইনবার চায়, যারা ঠাকুরবাড়িতে আগুন দেছে, তারা হামার বাড়িত আসপে নাকি?’

যার কথিত ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে এত ঘটনা সেই আলোচিত টিটু রায়ের পাশের বাড়ি বাসন্তী চক্রবর্তীর। যখন টিটু রায়ের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন তাঁরা যে ভয় পেয়েছেন, তা এখনো তাঁদের তাড়া করে ফিরছে। বাসন্তী চক্রবর্তী বলেন, ‘আরেকটু
হইলে সেদিন হামার বাড়িত আগুন লাগিল হয়। ফির (আবার) আগুন দেয় নাকি সেই চিন্তায় আছি।’ পাশেই মোহিনী রায় বলেন, ‘রাইতে এ বাড়ির বেটাছাওয়া ঘুমায় না। পুলিশের সঙ্গে পাহারা দেয়।’

টিটু রায়ের বাড়িতেই দেখা হলো তাঁর মা জীতেন বালার সঙ্গে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ম্যালামাইনের ছোট একটি বাটি নিয়ে টিউবওয়েল চেপে নিজেই নিজের মাথায় পানি দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কথা বলার চেষ্টা করে জবাব পেলাম: ‘ফ্যাদলা পারির পাবার নই (বেশি কথা বলতে পারব না)।’

ঠাকুরপাড়াতেই মিলন সরকার বারবার করে জানতে চাইছিলেন, ‘যদি টিটু রায় অপরাধ করে থাকে, তাহলে টিটু রায়ের শাস্তি হবে। আইনেই শাস্তি হবে। টিটু রায়ের বাড়ির মানুষের, তার পাড়ার লোকজনের অপরাধ কী? পাশেই পুড়ে যাওয়া বাড়ির উঠানে বসে চারুবালা জানতে চান, ‘হামার বাড়িত আগুন দেইল ক্যা? হামার দোষ কী?’ মিলন সরকার কিংবা চারুবালার প্রশ্নের মতো একই প্রশ্ন তো দেশবাসীরও। যে টিটু রায়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ৮-১০ বছর ধরে বাড়িতেই থাকেন না। তাঁকে এরই মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। তদন্তে অপরাধের প্রমাণ না মিললে তিনি মুক্তি পাবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কেউ এ রকম একটি পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে ষড়যন্ত্র করেছে কি না, তা খুঁজে বের করা ও দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ঠাকুরপাড়া গ্রামের হিন্দু পরিবারে আগুন দেওয়ার কয়েক দিন আগে থেকেই সেখানে সভা হয়েছে, মাইকিং হয়েছে। স্থানীয় জনগণের এই ভাষ্য যদি সত্য হয়, তাহলে সরকারি প্রশাসন কেন নীরব ছিল? সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কি এ ধরনের হামলার প্রস্তুতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেনি? সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার নির্যাতন-হামলা হচ্ছে। সেগুলোর যদি শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তবে তা দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করত, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। রংপুরের হরকলিতে যে ঘটনা ঘটেছে, এর অনেক প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। টিটু রায়ের বিরুদ্ধে আয়োজিত সভায় কারা বক্তৃতা করেছে, কারা গ্রামে গ্রামে মাইক দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে—এগুলোর কোনোটাই গোপন নয়। এখন পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঘটনা ম্লান হয়ে না যায়।

১০ নভেম্বরের পর থেকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার মানুষ হরকলির ঠাকুরপাড়া গ্রামে গেছেন সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের এই আস্থা তৈরি হয়নি, যে তারা এখনো নিরাপদ। হরকলির পার্শ্ববর্তী একটি ইউনিয়ন চন্দনপাট। সেখান থেকে আবদুর রহিম, ধীরেন ও জলিল নামের তিনজন একসঙ্গে এসেছেন অবস্থা দেখতে। জলিল বলেন, ‘ফজরের নামাজের আগে হামার বাড়ির দিকে কয়েকজন ছেলে কোথায় যেন যায়। এরাই এই কাজ করছে নাকি কে জানে?’

একটি স্কুলের তিন বন্ধু সুইটি আক্তার, রীতা রায় ও আবদুল বাতেন একসঙ্গে ঘটনা জানতে এসেছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁরা হামলার কঠোর নিন্দা ও ঘৃণা জানাচ্ছিলেন। তাঁরা অপরাধীদের শাস্তি চান। রহমতুল্লাহ নামের একজন ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, ‘যারা আগুন লাগাইল, তাদের শাস্তি হয় না ক্যা? এমার (এদের) জন্যে মুসলমানের বদনাম হয়।’

যে বাড়িগুলো পুড়ে গেছে, এখনো সেখানে পোড়া গন্ধ লেগে আছে। বাড়ির উঠানের আম-জাম-কাঁঠাল-নারকেলসহ বেশ কিছু গাছ আগুনে পুড়ে গেছে। কোনো কোনো বাড়ির গরু পুড়ে গেছে। বাড়িগুলোতে লুটপাটও হয়েছে। কারও কারও লুটপাট হওয়া গরু-ছাগল এখনো পাওয়া যায়নি। পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর স্থানে টিনের চালা তোলা হয়েছে। নতুন টিনে চকচক করছে বাড়ি। তারপরও উঠানে পুড়ে যাওয়া গাছগুলোর মতোই যেন পুড়ে গেছে ওই পাড়াবাসীর মন।

মন পুড়ে যাওয়ার ক্ষত দূর করতে হলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিয়ে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাতারাতি এই ক্ষত না সারলেও এ ধরনের ব্যবস্থা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়তা করবে।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।