'সুদারু'র শোষণে সুদিন শেষ

‘আমার শাশুড়ি এক সাগাইরটে (আত্মীয়র কাছে) ১০ হাজার টাকা ধার নিছলো। পরিশোধ না করলে মানসম্মান থাকে না। সেই জন্যে পাশের বাড়ির এক সুদারুর কাছ থাকি সুদের পর টাকা নিছলো শাশুড়ি। ১০ হাজার টাকা সুদারুর কাছ থাকি নেওয়ার পর এক বছরে গরু বেচে ৫০ হাজার টাকা শোধ করছে। মাসে হাজারপ্রতি তিন শ টাকা সুদ দেওয়া নাগচে।’ কয়েক দিন আগে রংপুরের পার্ক মোড় এলাকায় ছোট্ট এক দোকানে রহমত আলী নামের এক ব্যক্তি এ কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। যারা সুদের বা দাদন ব্যবসা করে, তাদের রংপুরের স্থানীয় ভাষায় ‘সুদারু’ বলে। এই সুদের ব্যবসা যে কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা সমাজের ওপরের খোলস দেখে বোঝার উপায় নেই। 

অগত্যা সুদারুর খপ্পরে
বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই উচ্চ হারে সুদের বিনিময়ে সুদারুদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিছুদিন আগে এক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সুদারুদের প্রসঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘ব্যাটাক নার্সিং পড়াইতে সুদের পর টাকা নিছি। সুদারু ছাড়া নগদে কাঁয় (কে) দেবে সেই টাকা? সেই টাকার সুদ দেওয়া নাগে অনেক। সুদের টাকা শোধ করার জন্য রিকশা চালাই। আগে রিকশা চালাই নাই।’ গাইবান্ধা জেলায় এ রকম একজন ঋণগ্রহীতা বলছিলেন, ‘আগের দিন বিপদে পড়লে মানুষ মানুষকে টাকা ধার দিত। বিশ্বাস ছিল। এলা আর কাঁয়ো কাকো টাকা ধার দেয় না। সেই জন্যে মানুষ সুদারুর পাছোত ছোটে। সুদের পর টাকা নেওয়ার যে কি যন্তন্না, সেটা হামরা বুঝি।’ উচ্চ হারে সুদের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার কারণে অনেকের ঘুম হারাম হয়েছে। অনেকেই টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়ান। 

সুদের হার

সুদের হার স্থান, ব্যক্তি, ঋণের পরিমাণ এবং ব্যক্তির চাহিদার ওপর নির্ভর করে। এই সুদের হার এলাকাভেদে হাজারে মাসিক ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চলছে। গ্রহীতা যদি বিপদে পড়ে আসেন, তাহলে সুদের হার বৃদ্ধি পায়। অনেকেই ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাজারে ৩০০ টাকা নিয়ে থাকে। কুড়ি হাজার টাকা থেকে ঊর্ধ্বে হলে সাধারণত হাজারে মাসিক ২০০ কিংবা ১০০ টাকা নেয়।

সুদ লেনদেনের বিচিত্র কৌশল

ঋণের টাকার পরিমাণ বেশি হলে অনেক সময় জমির দলিল রেখে সুদারুরা ঋণ দেয়। হতদরিদ্রদের ঋণ দেওয়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের কাছ থেকে চেক নেয়। এমন হয়, কয়েক মাসের চেক বন্ধক রেখে চাকরিজীবীরা ঋণ নেন। কৃষকদের ঋণ নেওয়ার পদ্ধতি আলাদা। ধান কাটার যত আগে কৃষক সুদের বিনিময়ে টাকা নেবে, তত বেশি ধান দিতে হবে। যদি বন্যায় ধান ডুবে যায়, তাহলে ওই সময়ের ধানের বাজারমূল্য দেখে সেই টাকা দিতে হয়। নয়তো ওই টাকার ওপর আবার সুদ গণনা শুরু হয়। 

টাকা পরিশোধের যত নিয়ম

কেউ মাসিক ভিত্তিতে নিয়মিত শুধু সুদ পরিশোধ করেন, কেউ একেবারেই সুদাসল দেন। কেউ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে শোধ করেন। এমনও আছে, সুদগ্রহীতা ছোট ব্যবসায়ী হলে তিনি প্রতিদিন সুদের টাকা শোধ করেন। এসব টাকা তোলার জন্য সুদারুদের লোক নিয়োগ করা থাকে।

প্রকাশ্যে সুদের কারবারি

সারা দেশে প্রকাশ্যেই চলছে এই সুদের ব্যবসা। সুদারুদের চেনেন স্থানীয় সবাই। নামের সঙ্গে তাদের সুদারু বিশেষণ যুক্ত হয়ে আছে। এদের ক্ষেত্রে কোনো আইনের প্রয়োগ নেই। যাঁরা কিছুটা সামর্থ্যবান, তাঁরা হয়তো দ্রুতই টাকা পরিশোধ করে মুক্তি পান। কিন্তু যাঁরা অভাবী, তাঁদের পক্ষে এই চক্র থেকে আর বের হওয়া সম্ভব হয় না। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে সুদের পরিমাণ, বাড়তে থাকে তাঁদের জীবনের কষ্ট। 

টাকা তোলার কৌশল

সুদারুদের সংঘবদ্ধ চক্র থাকে। টাকা ফেরত দিতে না চাইলে সংঘবদ্ধ চক্র সেই টাকা উদ্ধারে নানান কৌশলে চাপ দিতে থাকে। অনেক সময় পুলিশের মাধ্যমেও সুদারুরা টাকা তোলেন। সুদারুরা নিজেদের প্রয়োজনে একদল উচ্ছৃঙ্খল তরুণ তৈরি করেন। যারা তাঁদের টাকা তুলে দেওয়ার কাজ করে থাকে।

সুদারুরা কি অপ্রতিরোধ্য

সরকার চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে এই সুদের ব্যবসা বন্ধ করতে পারে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই ভয়ংকর ব্যবসা ব্যাংকগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকগুলোরও ঋণদান ব্যবস্থা এমন হওয়া দরকার, যেন সাধারণ মানুষ কখনোই সুদারুদের কাছে যাবে না। আর সুদারুদের বিরুদ্ধে শক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে আর কেউ সুদের ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে পারবে না। সমাজের এত বড় অন্যায় বন্ধে কি সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে নাকি তারা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপ্রতিরোধ্য? 

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com