বাল্যবিবাহ

'মেয়ে তো এখন ডাঙ্গর হইছে'

শিশুবিবাহ রোধের জন্য আইন করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ আইনের বিধিমালা কঠোর করা হচ্ছে। অনেক এলাকায় ইউএনও, পুলিশ খবর পেয়ে বিয়ের আসরে গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ফলে শিশুবিবাহ কমছে, কিন্তু খুব বেশি কমছে বলা যাবে না। এখনো শিশুবিবাহের হারের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে। এটা চার-পাঁচ বছর আগের হিসাব। তখন এই হার ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশের সামান্য বেশি। প্রায় তিন যুগ আগে ছিল অনেক বেশি, প্রায় ৭৩ শতাংশ। তারপর অনেক কমেছে। কয়েক বছর আগে এই হার আরও কম ছিল। এখন কিছুটা বেড়েছে।

এই হিসাবগুলো ২০১৪ সালের জনমিতিসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত বা ডেমোগ্রাফিক ডেটা থেকে জানা গেছে। ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশে শিশুবিবাহ পরিস্থিতি’ বিষয়ে প্রথম আলোর গোলটেবিল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্‌লাল হোসেন এসব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিশুবিবাহের হার কমছে। কিন্তু যে গতিতে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটছে, সে তুলনায় শিশুবিবাহের হার আরও অনেক কমে আসার কথা।

শিশুবিবাহ রোধের জন্য করণীয় বিষয়ে সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। এর আগেও বেশ কয়েকবার উন্নয়ন–সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনের সহযোগিতায় আমরা একই বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক করেছি। সেখানে সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকেরাও উপস্থিত থাকতেন। সবারই একান্ত চেষ্টা—শিশুবিবাহ যেন কমিয়ে আনা যায়। এই ক্ষেত্রে যেন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে।

কিন্তু দুঃখজনক যে এখনো সে রকম বড় ধরনের সাফল্য আমরা দেখাতে পারছি না। শহরে যদিও–বা কিছুটা কম, গ্রাম ও শহরের বস্তি, প্রান্তিক গরিব এলাকায় মেয়েশিশুদের বয়স ১৩-১৪ না হতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। হরদম এটা চলছে। অথচ আইন বলছে, মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ ও ছেলেদের ২১। এর কম বয়সে বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বয়সের এই সীমারেখায় ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ হিসাবে একটা ফাঁক রাখা হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে ‘যদি, কিন্তু, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে যাওয়া’ প্রভৃতি শর্ত রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাত্রীর নিজের এবং তার অভিভাবকের প্রকৃত সম্মতি ও আদালতের রায় লাগবে। শিশুবিবাহ আইনত অনেকটা দুঃসাধ্য করে তোলার লক্ষ্যে বিধিমালা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

শিশুবিবাহের বিরুদ্ধে আমরা এত যে সোচ্চারভাবে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি, গোলটেবিল বৈঠক করছি, পত্রিকার পাতাজুড়ে বিশেষজ্ঞদের কথাগুলো ছাপাচ্ছি, তাতে কি কোনো কাজ হচ্ছে না? কেন নীতিনির্ধারকেরা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না? জিজ্ঞেস করেছিলাম ইউএনএফপিএর কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলেছেন, এসব কথাবার্তায় এখন কিছু কাজ হচ্ছে। ওষুধে ধরছে। যেমন শিশুবিবাহ রোধের জন্য গৃহীত আইনের আপত্তির ফাঁকগুলো এবং আইনের অপব্যবহার বন্ধ করার লক্ষে্য বিধিমালায় বেশ কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আইনের ফাঁকফোকরে সহজে কোনো মেয়েশিশুকে খেয়ালখুশিমতো বিয়ে দিয়ে দেওয়া কঠিন। আইনের বিধিনিষেধ বেশ কড়া। এটুকু যে হয়েছে, তা আমাদের এসব গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের অভিমতের প্রতিফলন।

আইন যদি কঠোর হয়, তাহলে কেন শিশুবিবাহের হার দ্রুত কমে আসছে না? ব্যাপারটা কী?

এই প্রশ্নের ওপর আমরা এখন গুরুত্ব দিচ্ছি। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বললেন, গ্রামের দিকে কোনো পরিবারে মেয়ের বয়স ১৩-১৪ বা এমনকি ১০-১১ হলেই অভিভাবকেরা বলেন, ‘মেয়ে তো এখন ডাঙ্গর হইছে, বিয়া দিয়া দেও’! তার মানে, অভিভাবকেরাই তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে আগ্রহী। এটা একটা বড় সামাজিক সমস্যা।

এখানে লক্ষ করুন, অভিভাবকেরা বলছেন, ‘বিয়া দিয়া দেও।’ তার মানে আমাদের দেশে, বিশেষভাবে স্বল্পবিত্ত-নিম্নবিত্ত, শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারগুলোর মেয়েরা বিয়ে ‘করে’ না, তাদের বিয়ে ‘দেওয়া’ হয়। বিয়ের ব্যাপারে পাত্রীর কথার দাম নেই। সেখানে আইনে ‘পাত্রীর সম্মতি’ বা যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো, তাদের অল্প বয়সে পারিবারিক হুকুম জারি করে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

এখানেই মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।

তবে এই সমস্যার পেছনে আছে বখাটেদের উৎপাত। সরকার গ্রামে গ্রামে মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষা, শিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু অনেক এলাকায় বখাটেদের উপদ্রবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া কঠিন। তার ওপর আছে নারীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গ্রামে গ্রামে নারীদের হেয় করা। নারী নির্যাতন বাড়ছে। এসব কারণেও অনেক পরিবার মনে করে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। নিরাপত্তার বিষয়টিই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে।

এর ওপর আছে অভিভাবক ও একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তির কারসাজি। ওরা স্থানীয় অফিসে অনিয়মের মাধ্যমে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে আসে। আবার বিয়ের রেজিস্ট্রারও কারসাজি করে থাকেন। কোনো এলাকায় শিশুবিবাহের খবর পেয়ে থানা-পুলিশের বাধা এলে অভিভাবকেরা অন্য উপজেলায় গিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এমনকি মাঝনদীতেও বিয়ের রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করা হয়। এতে থানা-পুলিশের বাধার ভয় কম!

সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকে অনেক আলোচক বলেন, আইনের কড়াকড়ি ও সঠিক প্রয়োগ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি এলাকার চিহ্নিত বখাটেদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা এখন বেশ বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। পাশাপাশি মানুষের সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

কেন ১৮ বছর? অনেকে ভাবতে পারেন আগের দিনে তো ১৩-১৪ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তাহলে সমস্যা কী? কিন্তু তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন সেই আগের দিনে অল্প বয়সে বিয়ের পরপরই সন্তান জন্মদানের সময় কতজন মা ও শিশুর অকালমৃত্যু হতো? আর যারা বেঁচে থাকত, তাদের কতজন জন্মগত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগত? যে মেয়ে নিজেই শিশু, তার পক্ষে কি কোনো সুস্থ-সবল শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব? তারপরও আগে চল ছিল। তারা সমস্যাগুলো জানত না। এখন আধুনিক যুগে সবকিছু জেনেশুনে সেই আগের দিনের উদাহরণ টেনে শিশুবিবাহ দেওয়া মানে নবজাতক ও তার অল্প বয়সী মায়ের মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া। এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।

শুধু বিয়ে নয়, সে তো ১৮ বছরের আগে পুরোপুরি বেআইনি হতেই হবে, পাশাপাশি বিয়ের পর আরও দুই বছর, অর্থাৎ ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান ধারণও নিষেধ। এই আইন মানতে বাধ্য করতে হবে সব দম্পতিকে। কারণ, অন্তত ২০ বছর না হলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সন্তান জন্মদানের জন্য কোনো নারীর শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ হয় না। এ কথাটা আমরা অনেকেই জানি না।

আরেকটা কথা, ‘মেয়ে তো এখন ডাঙ্গর হইছে’—এ রকম ঠুনকো যুক্তি যেন আর শুনতে না হয়। আমরা যদি নারীর ক্ষমতায়ন চাই, তাহলে শিশুবিবাহ অবশ্যই একেবারে কমিয়ে আনতে হবে। এবং ২০৪১ সাল নয়, ২০৩০ সালের মধ্যেই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চাই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের এই সময়সীমার মধ্যে আমরা যদি বাল্যবিবাহের হার শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে সেটা হবে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail.com