স্ত্রীর লাশ দেখে ঘরে ফিরে মা-হারা সন্তানের মুখোমুখি হওয়া কী গভীর বেদনার বিষয়, সংবেদনশীল মানুষের কাছে তা সহজেই অনুমেয়। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর হাতে দুই সন্তানের দেখভালের যাবতীয় ভার তুলে দিয়ে তিনি সমাজ-রাষ্ট্র, মোদ্দাকথা সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন। শুধু তাঁর স্ত্রী বলে মিতু কতটা বঞ্চিত হয়েছেন, এখন যেন তা উপলব্ধি করতে পারছেন বাবুল আক্তার। গভীর দীর্ঘশ্বাসের মতো উচ্চারণ করেছেন—‘আমি মিতুকে কিছুই দিতে পারিনি। এমনকি কখনো একটি ভালো কাপড়ও কিনে দিইনি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। কিছুই পারিনি...।’
জানি না মাহমুদা খানমের মধ্যে বঞ্চনার বোধ কতটা ছিল। তিনি নিজে একজন পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা। পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ যেমন বহুবিদিত, তেমনি একজন সৎ, নীতিনিষ্ঠ পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য আর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা তাঁর না-জানার কথা নয়। বাবুল আক্তারকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন ও চিনেছেন তাঁরা তাঁর সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, অদম্য সাহস ও মনোবলের কথা জানেন। মাহমুদা খানম হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ যে দিনের পর দিন বিচার চেয়ে রাস্তায় মানববন্ধন করছেন, তার পেছনেও আছে এই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা। তিনি কর্মক্ষেত্রে নানা সময়ে পুরস্কৃত হয়েছেন মেধা ও সাহসের জন্য। রাষ্ট্রপতির পদকও লাভ করেছেন। তাই মাহমুদা হয়তো নিজের জীবনে কী পেয়েছেন আর কী পাননি তার হিসাব না মিলিয়েও স্বামীকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন। দুই সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর।
বাবুল আক্তারকে যখন যেখানে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি সেখানেই সে দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা ও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সাধারণ চুরি-ডাকাতি বা দাঙ্গা-ফ্যাসাদের ঘটনা যেমন তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দিয়েছেন, তেমনি তাঁর হাতে অনেক রহস্যজনক অপরাধের তদন্ত নতুন মাত্রা পেয়েছে, উন্মোচিত হয়েছে প্রকৃত ঘটনা। এ মুহূর্তে অন্তত দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে আসল সত্যটি বেরিয়ে এসেছিল।
২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় লেংটা ফকিরের মাজারে খুন হন কথিত লেংটা ফকির ও তাঁর এক খাদেম। এর অল্প কিছুদিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর নগরের মাঝিরঘাটে এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সেখানে ছিনতাইকারীদের ছোড়া বিস্ফোরকের বিস্ফোরণে মারা যান দুজন ছিনতাইকারী ও একজন সাধারণ নাগরিক। নিহত নাগরিকের নাম-ধাম-পরিচয় পাওয়া গেলেও দুই ছিনতাইকারীর পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। পরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এই দুজনের লাশ দাফন করে। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে জঙ্গি হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। সে বছর ১৭ আগস্ট সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা এবং ৩ অক্টোবর ও ২৯ নভেম্বর আদালত ভবনে হামলার পর জেএমবির বিস্ময়কর উত্থান ও তৎপরতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছিল প্রশাসনসহ সাধারণ মানুষ। জেএমবির নেতৃত্বে থাকা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাই নামে পরিচিত সিদ্দিকুল ইসলােমর গ্রেপ্তার ও বিচারে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সংগঠনটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এরপর ১০টি বছর তাদের সে রকম কোনো তৎপরতা না থাকায় সাধারণভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে এ সংগঠনের আর অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু বাবুল আক্তারের হাতে মাঝিরঘাটের ছিনতাই ঘটনাটির তদন্তভার ন্যস্ত হলে তিনি সম্পূর্ণ নতুনভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। প্রথমত, ঘটনাস্থলে বিস্ফোরক হিসেবে এমন কিছু আলামত পাওয়া যায়, যা সাধারণ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, বিস্ফোরক ছাড়াও ছিনতাইকারীরা ব্যবহার করেছিল দুটি একে ২২ রাইফেল, যা সাধারণ অপরাধীদের জন্য সহজলভ্য নয়। তা ছাড়া সাধারণ ছিঁচকে ছিনতাইকারী হলে নিহত দুজনের–নামধাম–পরিচয় উদ্ধার করা কঠিন হতো না। যেহেতু ওই দুজন ছিনতাইকারীর পরিবারের কেউ পরিচয় দিয়ে লাশ বুঝে নিতে আসেনি, তাই তাদের সঙ্গে আরও বড় কোনো চক্রের যোগাযোগের সন্দেহ দানা বাঁধে। ঘটনার প্রায় ১৩ দিন পর পালিয়ে যাওয়া দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হন বাবুল আক্তার। তাদের কাছ থেকেই জানা যায় ঘটনাটির পেছনে আছে জেএমবি। জঙ্গিদের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্যই ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বাবুল আক্তারের এই অভিযান থেকেই সেদিন বেরিয়ে এসেছিল নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে জেএমবি। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ১৬ অক্টোবর নগরের খোয়াজনগর এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির সামরিক কমান্ডার জাবেদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন বাবুল আক্তারকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছিল এই জঙ্গিরা। পরে জাবেদ নিহত হয়েছিলেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে। বাকি চার জঙ্গি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তহবিল সংগ্রহের জন্য ছিনতাই এবং ‘শরিয়তবিরোধী’ কাজের জন্য লেংটা ফকির ও তাঁর খাদেমকে হত্যার দায় স্বীকার করে।
এভাবে সাধারণের চোখে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার পেছনে জঙ্গি তৎপরতার রহস্য উদ্ঘাটন করে দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকায় জেএমবির চট্টগ্রাম শাখার প্রধান রাইসুল ইসলাম ওরফে ফারদিনের ভাড়া বাসায় বাবুলের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে অত্যাধুনিক রাইফেল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, সেনাবাহিনীর পোশাকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় ফারদিনের তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। পরে ফারদিন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান।
>স্ত্রীকে কিছু দিতে পারেননি বলে হাহাকার করেছেন বাবুল আক্তার। মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে পারলে তাঁর মন অন্তত শান্তি পাবে
এভাবে একের পর এক সফল অভিযান চালিয়ে জেএমবির সংগঠিত হওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে ওঠেন বাবুল আক্তার। এ কারণেই জেএমবি তাঁকে টার্গেট করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি যে টার্গেট ছিলেন এ কথা বাবুল আক্তার যেমন জানতেন, তেমনি তাঁর সহকর্মীদের তথা পুলিশ বিভাগেরও তা অজানা ছিল না। কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা বা প্রস্তুতি যে ছিল না, মাহমুদা খানম হত্যাকাণ্ডই তার প্রমাণ। সাপের লেজে পা দিলে আমুণ্ডু তাকে জব্দ না করলে এই পরিণতিই স্বাভাবিক। শোকের মুহূর্তে বাবুল আক্তার বলেছেন, ‘কেউ নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি।’ এ কথায় তিনি কাকে দোষারোপ করতে চেয়েছেন জানি না, তবে এই গাফিলতির দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ এড়াতে পারে না।
১৮ মাসে অন্তত ৩৮ জনকে খুন করেছে গোপন আততায়ীরা। পুরোহিত, যাজক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সাধারণ দরজি—কেউই রেহাই পাচ্ছেন না এদের হিংস্র আক্রোশ থেকে। এর আগে নানা সময়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু এবার পুলিশ পরিবারের সদস্যের ওপর আক্রমণ চালিয়ে নতুন বার্তা দিতে চেয়েছে ঘাতকেরা।
সাধারণ মানুষের জান-মাল হেফাজতের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তারাই যদি অরক্ষিত হয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ নাগরিকের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক ছড়াবে। স্ত্রীকে কিছু দিতে পারেননি বলে হাহাকার করেছেন বাবুল আক্তার। মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে পারলে তাঁর মন অন্তত শান্তি পাবে।
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ স্ট্যাটাস দিয়েছেন, মাহমুদা খানম হত্যকাণ্ডের তদন্তভার বাবুল আক্তারের হাতে দেওয়া হোক। তিনিই প্রকৃত হত্যাকারীকে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবেন।
এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সাম্প্রতিক কালের ফিল্মি কাহিনির প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবন আর সিনেমার গল্প একই ধারায় চলে না। বাবুল আক্তার অনুকরণীয় হতে পারেন, কিন্তু এটা তাঁর একার লড়াই নয়। হিন্দি ফিল্মে সালমান খান বা অজয় দেবগন পরিচালকের নির্দেশে অসাধ্য সাধন করে হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারেন। বাস্তবে জঙ্গিগোষ্ঠী বা সমাজবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে দরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ।
দুর্ভাগ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গতানুগতিক বক্তব্যের মধ্যে সে রকম কোনো সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com