ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আমাদের বলে গেছেন যে তাঁর দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী আগে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ সবার আগে (‘পড়শি পেহলে লেকিন বাংলাদেশ সাবসে পেহলে’)। সুমধুর একধরনের ব্যঞ্জনা আছে এই বাক্যে। শুনতে ভালো লাগে। নানা সংকটে নিমগ্ন, বিশেষত প্রায় ১০ লাখ বিপন্ন এবং নিঃসম্বল রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয় ও জীবনধারণ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জে একটি শক্তিধর প্রতিবেশীর কাছ থেকে এ রকম আশ্বাসে স্বস্তি পাওয়ারই কথা। আমাদের ক্ষমতাসীন দল, সরকার এমনকি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলও কিছুটা উচ্ছ্বসিত বলেই মনে হয়।
রাজনীতিকেরা সব সময়ই সাফল্য দেখাতে উদ্গ্রীব থাকেন এবং সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাঁদের সেসব দাবির যথার্থতা যাচাই করাও জরুরি। রোহিঙ্গা সংকট,যা এক বিপর্যয় হিসেবে বাংলাদেশের সামনে হাজির হয়েছে, সেই সংকটে ভারতের অবস্থান কি সুষমা স্বরাজের বিবৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? মিয়ানমারও যেমন, আমরাও তেমন ভারতের পড়শি। কিন্তু ভারতের সমর্থনের পাল্লাটা কোন দিকে বেশি ঝুঁকে আছে, সেটি মোটেও প্রশ্নাতীত নয়।
সুষমা ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দেশের যে যৌথ সহযোগিতা পরিষদ (জেসিসি) আছে, তার বার্ষিক সভায় অংশ নিতে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন অভিযান এই অঞ্চলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে কি না এবং করলে সে বিষয়ে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য বোঝা। বাংলাদেশ এই বোঝা কত দিন বইবে? এর একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর সুষমা স্বরাজ সাংবাদিকদের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বয়ানটি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই বয়ানে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সুষমা রোহিঙ্গা সংকটের প্রসঙ্গটি অবতারণার শুরুতেই বলেছেন, ‘অতিসম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত লোককে কক্সবাজারে আশ্রয় দেওয়ার যে প্রশংসনীয় চেষ্টা বাংলাদেশ করেছে, তার সহায়তায় সেপ্টেম্বর মাসে আমরা অপারেশন ইনসানিয়াত শুরু করি।’ এরপর ভারত কী কী সহায়তা দিয়েছে, তার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি আরও যোগ করতে চাই যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনায় রেখে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছি।’
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরপর বলেছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি তখনই ফিরিয়ে আনা যাবে, যখন বাস্তুচ্যুত লোকজন রাখাইন রাজ্যে ফিরতে পারবে। আমাদের দৃষ্টিতে রাখাইন রাজ্যের সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে সেখানকার আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যা রাজ্যটিতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভারত তার তরফে, রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে মিলে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা কফি আনানের নেতৃত্বাধীন বিশেষ পরামর্শক কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছি।’
এই বিবৃতিতে সহিংসতা বন্ধের কোনো আহ্বান নেই। বলা হয়েছে, জনগণের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার। পুরো বিবৃতিতে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচিতি, জাতিগত নিধন এবং গণহত্যা, এমনকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের মতো বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো বিশ্ব যখন সহিংসতার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দায়ী করছে, তখন সমস্যার উৎস এবং দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারণে ভারত বিরত থাকছে। এ থেকে মিয়ানমারের প্রতি ভারতের সহানুভূতিমূলক অবস্থানটিই স্পষ্ট হয়। মিয়ানমার যেহেতু রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না, সেহেতু বাস্তুচ্যুতদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে ভারতীয় বিবৃতিতে কোনো ধরনের চাপ অনুভবের প্রশ্নই উঠবে না। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সমর্থনের কথা ঘোষণাতেও রয়েছে কূটনৈতিক প্রলেপ। নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনা এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যে যেখানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সে রকম কোনো আহ্বান জানাতেও ভারত যে প্রস্তুত নয়, এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে ভারত এর আগেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহ দমনের সময় পরিচালিত গণহত্যায় তা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতের বিপুল তামিল জনগোষ্ঠীর চাপ সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কায় তামিলদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের ব্যর্থতা বহুল আলোচিত। শ্রীলঙ্কার গণহত্যা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। এখন জাতিসংঘের সহায়তায় সেখানে তদন্ত চলছে। মিয়ানমারের গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রেও বিস্ময়করভাবে ভারত একই নীতিতে চলছে। বলা হয়ে থাকে, মিয়ানমারে ভারতের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। অন্যতম একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে চীনের পাল্টা অবস্থান গড়ে তোলার জন্য ভারত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে চায়। রোহিঙ্গা নিধন শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারে এপর্যন্ত যে একজন রাষ্ট্রনেতা সরকারি সফরে গেছেন, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুধু তা-ই নয়, তিনি সেখানে কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে এসেছেন। মিয়ানমার এ রকম দ্ব্যর্থহীন সমর্থন অন্য আর যে দেশগুলোর কাছ থেকে পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে চীন ও রাশিয়া।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের মহানুভবতার প্রশংসা করা এবং ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর পর্বটি সহজ। কিন্তু বিপরীত বাস্তবতা হচ্ছে ভারত মাত্র ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আর এক দিনের জন্যও রাখতে প্রস্তুত নয়। সেখানকার সরকার আদালতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তাদের বের করে দেওয়া যায়। এমনকি বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর খবরও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকা ২৪ অক্টোবর খবর দিয়েছে, সরকারের কঠোর নীতির কারণে অনেক রোহিঙ্গা নিজেরাই বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে। তাদের খবরে গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৫০ জন রোহিঙ্গার এভাবে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে
(ইন্ডিয়াস ফার্ম পলিসি পুশেজ মোর রোহিঙ্গাস টু বাংলাদেশ)। রোহিঙ্গাদের কোথাও ফেরত যাওয়ার কথা থাকলে সেটা তো হওয়ার কথা মিয়ানমার। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ সাবসে পেহলে’।
প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে, এমনকি বাগ্বিতণ্ডাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ভারতে কথিত অবৈধ বাংলাদেশি ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনীতি মোটেও স্বাভাবিক নয়। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে তা ক্রমেই বাংলাদেশ বিদ্বেষের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে বাংলাভাষী মানুষের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান। এখন আসামে ঘোষণা করা হয়েছে ৩০ লাখ কথিত অবৈধ বাংলাদেশিকে বহিষ্কারের। তাদের ক্ষেত্রেও মন্ত্র কিন্তু ‘বাংলাদেশ সাবসে পেহলে’।
‘বাংলাদেশ সাবসে পেহলে’ বলে যদি সত্যিই কোনো নীতি ভারত গ্রহণ করে থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রথমেই দেখা উচিত ওই নীতিতে ন্যায্যতার কথা আছে কি না। ন্যায্যতা ছাড়া ‘পেহলে’ হলে তা বাংলাদেশের জন্য কতটা কল্যাণকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। স্বাধীনতাসংগ্রামে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ ও ঋণী, কোনো সন্দেহ নেই। আর সে কারণে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই সম্পর্কে বাংলাদেশেরও প্রত্যাশা পূরণের প্রশ্ন আছে। দ্বিপক্ষীয় সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ অপেক্ষা করেছে প্রায় ৪০ বছর। এখনো সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের প্রাণহানি ঘটছে। এ বছরেও প্রথম নয় মাসে ১৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন (তথ্যসূত্র: মানবাধিকার সংস্থা অধিকার)। পানির জন্য অপেক্ষার পালা এখনো চলছে এবং দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো আলোর রেখা নেই। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির হিসাব সব সময়ই বাংলাদেশের প্রতিকূলে।
‘সাবসে পেহলে’ হলেই যে তাকে সব সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং অভিজ্ঞতা বলে, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাকে কেউ কেউ শত্রুতাও বলে থাকেন, তার পটভূমিতেও বিচার করলে দেখা যাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর গুরুত্ব কতটা। ওই দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন নদ সিন্ধুর পানি ভাগাভাগির বিষয়টিতেও এর প্রমাণ মেলে। উপমহাদেশ বিভাজনের ৭০ বছরেও সিন্ধুর পানি নিয়ে বড় ধরনের কোনো গোলমাল বাধেনি। গত বছর ভারত সিন্ধুর পানি আটকে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ভারতের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, এমন প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। কিন্তু তার মানে প্রতিবেশীর কাছে সমমর্যাদা ও ন্যায্যতার কথা বলতে পারব না, তা নয়। সুতরাং আমাদের এখন জোর গলায় বলা প্রয়োজন, ‘বাংলাদেশ সাবসে পেহলে’—এমন অবস্থানের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা তারও আগে চাই ন্যায্যতা, অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ সাবসে পেহলে, লেকিন ইনসাফ (fairness) উসকে পেহলে’।
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।