২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি দিনটি গভীর চিন্তায় কেটে গেল। ১৯৭২ সালের এই দিনে আমি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ৫০টি শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী ছয় লাখ বাংলাদেশির ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল আমার। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি সেখান থেকে অক্সফামের একটি ল্যান্ডরোভার ও ট্রেইলারভর্তি ওষুধ ও উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার নিয়ে আমি যাত্রা শুরু করি। আমার ড্রাইভার ছিল বাদল নন্দী। সে ও তার পরিবার ১৯৭১ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে এসেছিল। অক্সফাম সেই বিপুল ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনার জন্য যে ১৩ জন গাড়িচালককে নিযুক্ত করেছিল, সে ছিল তাদের মধ্যে একজন। আমার সঙ্গে এক ব্রিটিশ সেবিকাও ছিল, তার নাম জিন টেইলর। সে ঢাকায় মাদার তেরেসার ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজে’ কাজ করতে রাজি হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি আমরা ভালো সময়ে যাত্রা শুরু করলেও বনগাঁও-বেনাপোল সড়ক ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। ফলে আমাদের গতি ছিল খুবই মন্থর। আমরা কিছুক্ষণের জন্য বনগাঁওয়ের গান্ধীবাদী অভয় আশ্রম ও ক্যাথলিক মিশনে থামি। অক্সফামের সহায়তায় এ দুই স্থানেই প্রচুর শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। দেশে ফেরতরত শরণার্থীরা যাতে সঙ্গে করে প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি, কম্বল ও গরম কাপড় নিয়ে যায়, তা তদারক করছিল এ দুই প্রতিষ্ঠান। আমাদের গাড়ি যে গতিতে চলছিল, তাতে বুঝলাম যে রাতটা সড়কেই কোথাও কাটিয়ে দিতে হবে। আমরা যশোরে ক্যাথলিক মিশন হাসপাতালে গেলাম। এই প্রতিষ্ঠানে অক্সফাম একসময় অনেক সহায়তা দিয়েছে। তারা আমাদের খুবই উষ্ণ ও উদার অভ্যর্থনা জানাল। সেখানে শুনলাম, একজন ইতালীয় পাদ্রিকে পাকিস্তানি বাহিনী কয়েক মাস আগে গুলি করে মেরেছে। তাঁর অপরাধ, তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন।
বিশ্রাম ও নাশতার পর আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। আশা ছিল দুপুরের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারব। আবারও দেখলাম, রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করা সেতু ও কালভার্টের কারণে আমাদের গতি আরও কমে যায়। ল্যান্ডরোভারের চার চাকার ড্রাইভ–সুবিধার বদৌলতে আমরা কোনো রকমে এগিয়ে চললাম। যাত্রাপথে অনেক গ্রামের ভস্মীভূত বাড়ির সামনে বেদনাহত মানুষকে ছলছল চোখে বসে থাকতে দেখলাম। এরপর ফেরিঘাটে এসে দেখি যানবাহনের লম্বা লাইন। ফেরিতে ওঠার সময় বিপত্তি ঘটল। ট্রেইলারটা খুলে কোনো রকমে গাড়িটা ঢোকানো গেল। কিন্তু সমস্যা ঘটল ল্যান্ডরোভার ঢোকানোর সময়। এর পেছনের বাঁ দিকে চাকাটা র্যা ম্পের ওপর আটকে গেল। ফলে ফেরি তো আর ছাড়া যায় না। শুরু হলো হট্টগোল। তবে এই লোকদের অনেকেই অক্সফাম সম্পর্কে জানত। শেষমেশ ১০ জন মানুষ ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় অক্সফাম’ স্লোগান দিয়ে পেছনের চাকাটা তুলে ফেরিতে ঢুকিয়ে দিল।
ফেরি পার হয়ে আবারও শম্বুকগতিতে যাত্রা শুরু হলো। পথে শত শত ভাঙা সেতু ও কালভার্ট। রাত ১২টার দিকে ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। হঠাৎ করে মনে হলো, পুলিশ ও সেনাসদস্যরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তারা যেন হাওয়া থেকে উদয় হলো। আমরা জানতে পারলাম, রাত ১২টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ রয়েছে। পরিচয় দেওয়ার পর আমাদের বন্ধুত্বসুলভ ঢঙে পাহারা দিয়ে মতিঝিলে পূর্বাণী হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে অক্সফামের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পোড় খাওয়া মানুষ জিম হাওয়ার্ডকে পেলাম। তিনি সাগ্রহে তাঁর দুই বেডের কামরায় আমাকে জায়গা দিলেন। সেদিনের মতো এমন ক্লান্ত আমি জীবনে আর কোনো দিনও হইনি।
আরও কিছুদিন বাংলাদেশে থাকলাম। আমার কাজ ছিল জিমকে সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় সহায়তা করা। ব্রিটিশ হাইকমিশন ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তারা উপদেশ দিলেন, আমরা যেন শেখ মুজিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি আমি কখনোই ভুলতে পারব না। আমি তাঁকে বললাম, ‘অক্সফামের মতো ছোট একটি সংগঠন কীভাবে বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সহায়তা করতে পারে, সে সম্পর্কে আমার কিছু পরামর্শ আছে।’ শেখ মুজিব মুখ থেকে পাইপটি বের করে আমাকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘যুবক, তুমি কীভাবে এখানে এসেছ?’ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার বিষয়ে তাঁকে অবহিত করলে তিনি বলেন, ‘তাহলে তুমি এ দেশ আমার চেয়ে বেশি দেখেছ। আমি তো নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলাম। তুমি আমাকে বলো, আমার দেশের কী দরকার। তুমি কী দেখেছ?’
আমি তাঁকে বললাম, পথে পথে বহু ভস্মীভূত গ্রাম এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত সড়ক ও কালভার্ট দেখেছি। বহু ফেরি ও লঞ্চ ডুবে গেছে। আমি আরও বললাম, বড় বড় ঘর বানানোর জন্য অক্সফামের পক্ষ থেকে আমি ইতিমধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের সিআই শিটের অর্ডার দিয়েছি। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সেতু নির্মাণ, ফেরি সংস্কার ও প্রতিস্থাপনই যথাযথ হয়। তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না, আমার জনগণের যোগাযোগের প্রাণ হচ্ছে ফেরি, তুমি বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে কথা বলো, আর দেখো অক্সফাম কিছু করতে পারে কি না।’
শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে শরণার্থীশিবিরে কাজ করতে কেমন লেগেছে। কথা বলার সময় আমি আবেগাপ্লুত হলাম। শেখ মুজিব আমার শরীরে হাত রেখে বললেন, ‘যাও যুবক, শক্তি সঞ্চয় করো। আমার সঙ্গে দেখা করা এবং বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ।’
শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর অক্সফাম তিনটি ফেরি কেনে। অন্যান্য ফেরি সংস্কারেও আমরা সহায়তা করি। আমার মনে আছে, বিআইডব্লিউটিএ বোধগম্যভাবেই ফেরিগুলোর নাম মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নামে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশের প্রাণী ও উদ্ভিদকুল যেভাবে এখানকার কবিতা ও সংগীতের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে, তা জানার পর আমরা প্রস্তাব করি, ফেরিগুলোর নাম ফুলের নামে রাখা হোক। ফলে এগুলোর নাম হয় কামিনী, কস্তুরী ও করবী। আমার মনে হয়, আজ ৪৩ বছর পরও এসব ফেরি পদ্মা নদীতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, মাওয়ায় যানবাহন ও মানুষ পারাপারে নিয়োজিত রয়েছে।
আজ থেকে ৪৩ বছর আগে সেই সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফরে আমার মনে হয়েছিল, তখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল খাদ্য ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি সাধন, যাতে সেই খাদ্য সব জায়গায় পৌঁছানো যায়। অক্সফামের সহায়তা পরিচালক কেন বেনেট আমার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সফরের পর এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘আমি জানি না এটা অতিরঞ্জন হবে কি না, খাদ্য আমদানি ও যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের সমস্যা যেভাবে মোকাবিলা করা হবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সেভাবেই নির্ধারিত হবে।’
বাংলাদেশ এখন তার প্রধান খাদ্য নিজেই উৎপাদন করছে, এ ক্ষেত্রে সে স্বনির্ভর হয়েছে। দেশের ভেতরে তা অনায়াসে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা–নেওয়াও করা যায়। আর সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও বাংলাদেশ ইতিবাচক অবস্থানে আছে। এই কৃতিত্ব বাংলাদেশকে দিতেই হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্সফামের হয়ে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয় করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ খেতাবে ভূষিত।