বনে আগুন লেগেছে, পশুপাখি সব পালাচ্ছে। বাঘ, হরিণ, ক্যাঙারুরা মাটির ওপর দিয়ে ছুটছে। ধোঁয়ায় ভরা আকাশে ছন্নছাড়া পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। যদি সোলায়মান বাদশার মতো পশুপাখিদের ডাক আমরা বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়তো শুনতাম দশ দিকে একই চিৎকার—বাঁচাও বাঁচাও। কিন্তু আমরা পাখিদের ভাষা না বুঝলেও একটা পাখি বুঝেছিল মানুষের ভাষা। সেই ভাষায় সে লোকালয়ে এসে মানুষের দরজার কাছে একটানা ডেকে গেছে। ভেবেছে, মানুষ বোধ হয় তাদের বাঁচাতে পারবে, নেভাবে বনের আগুন। তাই শহরের এক বাড়ির বেড়ার ওপর বসে একটানা সাইরেনের সুরে ডেকে যাচ্ছে, ডেকেই যাচ্ছে।
তার সুরটা দমকল বাহিনীর গাড়ির জরুরি ডাকের মতো, ছুটন্ত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মতো। পাখিটির স্পষ্ট সেই ডাক একজন ভিডিও করেছেন, সেই ডাক সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, বিশ্বের গণমাধ্যম পাখিদের সেই ‘এসওএস’ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে। অস্ট্রেলিয়ায় চলমান ঝোপঝাড় পোড়ানো আগুন থেকে বেরিয়ে মানুষের সাহায্য পেতে আসা পাখিটির ডাক কি কোনো অনুরণন তোলে আমাদের মনে? অস্ট্রেলিয়ার এই ম্যাগপাই পাখি আমাদের শালিকের মতো শব্দ অনুকরণ করতে পারে। সেই পাখির আকুল করা সাহায্যের আবেদন শুনে মন থমকে যায়। মনে হয়, দূষণে-আগুনে আর জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন পৃথিবীই যেন ডাকছে ওই পাখির সাইরেন-সুরে। ঘটনা গত বুধবারের।
বাংলাদেশের হাল আমলের ব্যান্ড সহজিয়ার একটা গান আছে, ‘ছোট পাখি ছোট পাখি/সর্বনাশ হয়ে গেছে। পৃথিবীর পরে তোমার আমার ভালোবাসার কোনো ঘর নেই।’ আমাজন পুড়ে যায়, বস্তি পুড়ে যায়, সুন্দরবন দূষিত হয়ে যায়, নদী মরে যায়, মরে যায় মানুষে মানুষে ভালোবাসার বাঁধন। মানুষের সেই হাহাকার, বনপোড়া হরিণীর আর্তনাদ, বাসা হারানো পাখিদের কান্না—সব একাকার হয়ে গেছে আজকের পৃথিবীতে। সবদিকে সর্বনাশের মুখে পড়া এই ছোট পাখি যে মানুষের কাছে এসেছে, বিপত্তারিণী দমকল বাহিনীর গাড়ির সাইরেনের সুর নকল করে মানুষের সাহায্য চেয়েছে, তাতে কি মনে হয় না যে আমরা একই ধরণির সন্তান?
আমাদের এই একটাই গ্রহ। বর্তমান হারে তাপ বাড়তে থাকলে সেই গ্রহ আর বর্তমান প্রাণিকুলের বেশির ভাগেরই বসবাসের উপযোগী থাকবে না। শ্যামল পৃথিবী একদিকে প্লাবিত, আরেক দিকে মরুময় হবে। মহাকাশ থেকে দেখা এই নীল গ্রহ হয়তো তখনো নীলই থাকবে, কিন্তু সেই নীলে মুগ্ধ হওয়ার মতো মানুষ আর থাকবে না। এখনই যদি সজাগ না হই, তবে বনপোড়া ওই পাখির মতো সেদিন আমরা কার কাছে গিয়ে সাহায্যের ডাক ডাকব?
বনপোড়ানো আগুনের এ ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার। সেই অস্ট্রেলিয়ারই কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’ আন্দোলনে নেমেছে। সেই ছোট্ট মেয়েটি জাতিসংঘের অধিবেশনে তীক্ষ্ণ গলায় পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য যে ডাক দিয়েছিল, তার সঙ্গে সেই অস্ট্রেলিয়ারই ওই ম্যাগপাই পাখির করুণ কান্নার কী পার্থক্য? দুজনই প্রকৃতির সন্তান। আর পশুপাখিরা তো প্রকৃতির শিশু, শিশুর মতোই নিষ্পাপ সারল্য চলে তাদের জীবন। ম্যাগপাইটির ডাক শুনে তাই মনে হয়েছে, ওটা কোনো পাখি না, সে যেন কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ—ভালোবাসার পৃথিবীটাকে বাঁচানোর জন্য যারা মানুষকে জেগে উঠতে বলছে।
যশোরে প্রাচীন একটি মন্দিরের পাশে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে দেখেছিলাম। ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। তাঁর ছেলেটি কোথায় যেন চলে গেছে। বাড়ির বারান্দায় একটা খাঁচা ঝুলছে। তার ভেতর দাঁড়ে বসা একটি শালিক একটানা ডেকে চলেছে ‘মামা’ ‘মামা’ ‘মামা’। বুড়ির ছেলেটিকে মামা ডাকত এই পোষা শালিক। যে নেই তাকে ডাকার নাম ভালোবাসা, যা হারিয়ে যাচ্ছে তাকে ধরে রাখার নাম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা পাখিও বোঝে, বন বাঁচাতে পাখিও ছুটে আসে মানুষের কাছে। অথচ আমরা মানুষ, এমনই মানুষ আমরা, পৃথিবীটা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, যুদ্ধে যুদ্ধে কত কত দেশ শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমাজন থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত দখল ও দূষণ চলছে; অকাতরে পোড়ানো হচ্ছে মানুষের বসতি ও বস্তি। কিন্তু কজন আমরা ওই অস্ট্রেলীয় ম্যাগপাই পাখির মতো ডেকে উঠি, উদাসীনদের ডাকতে তুলি জীবন বাঁচানো সাইরেনের আওয়াজ?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothomalo.com