‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলছি না।’ কথাটা বলেছিলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর নেতৃত্বে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির পাঁচজনের একটা যুক্ত দল পাঠানো হয় নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের জামশেন গ্রামে। কথিত অজ্ঞাত রোগে পাঁচজনের মারা যাওয়ার কথা প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হলে চিরাচরিত ঢাকা থেকে দলটিকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। জেলা–উপজেলার সব স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সংবাদকর্মীদের যখন বলছিলেন খামোখা রিউমার ছড়াবেন না, এটা তেমন কিছু না, সামান্য চিকেন পক্স বলতে পারেন, তখন প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধি ঢাকা থেকে পাঠানো বিশেষজ্ঞ দলের প্রধানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘মামুলি জলবসন্তই যদি হবে স্যার, তাহলে পাঁচ–পাঁচটি প্রাণ কেন ঝরে গেল?’ তখন এক কর্মকর্তা বলেছিলেন ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলছি না।’
রোগটি প্রথমে জামশেন গ্রামে দেখা দেয়, তারপর আশপাশের চার–পাঁচটি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। এক মাসের কিছু বেশি সময় লেগে যায় সরকারের টনক নড়তে। পুরোনো এক ইউপি চেয়ারম্যান সে সময় বলেছিলেন, ‘মাসখানেক আগে এই রোগ এলাকায় দেখা দেয়। কিন্তু এখন ডাক্তাররাও এই রোগ সম্বন্ধে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। কখনো বলছেন “ম্যানিনজোক্কাল মেনিনজাইটিস”, কখনো বলছেন জলবসন্ত। এই রোগে এ পর্যন্ত গ্রামের পাঁচজন মারা গেছে।’
আজ পর্যন্ত জানানো হয়নি রোগটি কী ছিল। এবারও একই গোলকধাঁধায় পড়েছে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গীর মানুষ। একটি গ্রামের এক বাসিন্দা বলেছেন, ১৫ দিনের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন মারা গেছে, কিন্তু কেউ রোগ শনাক্ত করতে পারছে না। দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, ঢাকা থেকে তদন্ত দল না আসা পর্যন্ত এবং নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্কুল দুটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরে চলাফেরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এবারও ঢাকার (আইইডিসিআর) থেকে একটি পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলকে রংপুরে পাঠানো হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখার পর তাঁরা সরেজমিনে পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঠাকুরগাঁও গেছেন। তবে তাঁরা ঠাকুরগাঁওয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে গেছেন বলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন শাহাজাহান নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেছেন, কী কারণে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এসব অজ্ঞাত রোগ অজ্ঞাতই থেকে যায়। পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে আর ‘গুজব’ না ছড়ানোর বিষয়ে শাসিয়ে দিলেই সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে নীরবতা নেমে আসে। কেউ আর প্রশ্ন করে না তারপর কী হলো। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের রোগটি শনাক্ত করার কথা। এটা তাঁদের কাজের অংশ। তাহলে কেন এ বিষয়ে জনগণকে কিছু জানানো হয় না?
গত ৯ বছরে শুধু রংপুর বিভাগেই অনেক মানুষের অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রচারিত হয়েছে। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অজ্ঞাত রোগে মারা যায় বড়াই গ্রামের ১৩ জন মানুষ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে ১৪ জন। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজের একটি বিশেষ টিম রোগটি এনকেফালাইটিস ভাইরাসের আক্রমণ বলে ধারণা করেছিল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিকদের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তারপর ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হন ওই এলাকার এক পল্লিচিকিৎসকসহ মোট ১২ জন। ২০১৫ সালের জুনে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর, সদর, বিরল, বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর আর কাহারোল উপজেলার ১০ শিশু অজ্ঞাত রোগে মারা যায়।
অজ্ঞাত রোগ উত্তরের জনপদে সীমাবদ্ধ থাকছে না। আইইডিসিআর গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ গাজীপুরে অজানা রোগে মৃত্যুর তথ্য পেয়েছিল। তারা বলেছিল, মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করার কাজ চলছে। উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর জায়গায় হঠাৎ গাজীপুরে অজ্ঞাত রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মানুষের চলাচল সঙ্গে সঙ্গে রোগব্যাধিও ছড়ায়।
দারিদ্র্যের কারণে গ্রামে আর শখের কারণে নগরে পশুপাখির সঙ্গে একই ঘরে থাকার প্রবণতা নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। চিন্তা বাড়ছে লেপ্টোসপাইরেসিস নিয়ে। শরীরের যেকোনো জায়গায় সামান্য কাটাছেঁড়া থাকলে অ্যানথ্রাক্স–আক্রান্ত গবাদিপশু থেকে মানুষের দেহে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ঢুকতে পারে। একইভাবে আক্রমণ করে লেপ্টোসপাইরোসিস নামের রোগটি। সাধারণত ইঁদুর, গবাদিপশু, কুকুরের প্রস্রাব শরীরের কোনো অংশে প্রবেশ করলে এ রোগ দেখা দিতে পারে। অনভিজ্ঞ চিকিৎসক লক্ষণ দেখে হয়তো চিকিৎসা দিতে শুরু করবেন, তাতে রোগ ভালো না হয়ে অজ্ঞাত রোগের প্রাদুর্ভাবসংক্রান্ত গুজবের আজাব বাড়বে। গত দুই বছরে লেপ্টোসপাইরোসিসে ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫ জন। উত্তরার আশপাশের এলাকায় রোগটিতে আক্রান্তের হার ছিল সবচেয়ে বেশি।
অজ্ঞাত রোগে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও মারা যায়। ২০১৬ সালে বরগুনার একটি গ্রামে এক সপ্তাহে কথিত অজ্ঞাত রোগে ১৫টি গরু মারা যায়। স্থানীয় কৃষকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়লেও তাঁদের করার কিছু ছিল না। সে সময় আমতলী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ এসব খবর জানায়নি।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের সঙ্গে মাঠের যোগাযোগের এ এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ। পরে অবশ্য তিনি কবর থেকে গরু উঠিয়ে আলামত সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রেও পরীক্ষার ফলাফল গরুর মালিকদের কাছে পৌঁছায়নি। হাজার ঘটনার এটি
একটি নমুনামাত্র।
এখন সময় এসেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণের। জেলায় জেলায় এখন মেডিকেল কলেজ। উত্তরের সব মেডিকেল কলেজ নিয়ে কি একটা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়? তারা অজ্ঞাত রোগের খবর পেলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছুটে যাবে রোগী মারা যাওয়ার আগে। ঢাকার মতো গবেষণাগার জেলা পর্যায়েও গড়ে তোলা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত।
গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক
nayeem5508@gmail.com