'এনু-রুপন ব্যাংক' এবং পাবলিকের পটোল কেনা ও তোলা

দুই ভাইয়ের ‘ব্যাংকে’ মিলেছে পাঁচটি সিন্দুক। এসব সিন্দুকে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। ফাইল ছবি
দুই ভাইয়ের ‘ব্যাংকে’ মিলেছে পাঁচটি সিন্দুক। এসব সিন্দুকে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। ফাইল ছবি

বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, পাবলিক পেরেশানিতে আছে। দুদণ্ড শান্তি কোথাও নেই। এমনকি নাটোরেও নেই। ভালো খবর এখন দুষ্প্রাপ্য প্রোডাক্ট। গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকা কিনে, টিভি দেখে বা ইন্টারনেটে চোখ রেখে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে পরান জুড়ায় না। জ্বলে। দেশ, বিদেশ—সবখানেই মাথা গরম করা খবর। তসবিহ ছিঁড়ে গেলে পুঁতিগুলো সুতা বেয়ে একটার পর একটা ধেয়ে এসে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সেভাবে একের পর এক অশান্তি ধেয়ে আসছে। করোনাভাইরাসের মতো পেরেশানির খবর ভাইরাল হচ্ছে।

পত্রিকা খুললেই হয় মাফিয়া নয়তো পাপিয়া। একদিকে শেয়ারবাজারে চরম মন্দা-ভাটা, অন্যদিকে পদক নিয়ে লজ্জায় জিব কাটা। একদিকে করোনা হানা—বিশ্ববাজার শেষ, অন্যদিকে দিল্লি-দাঙ্গা, ছারখার সবশেষ।

এ ধরনের খবর লাইন দিয়ে হেডলাইন হচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘টাকার খোঁজে সরকার’। প্রতিবেদনের চুম্বক কথা ছিল, ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ। ঋণখেলাপির নামে লুটপাট করে সব ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। টাকার জন্য সরকারের মাথা গরম হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো থেকে যে পরিমাণ অর্থ সরকার সারা বছরে নিয়ে থাকে, তা সাত মাসেই নেওয়া হয়ে গেছে। এখন টাকা পাওয়ার জন্য নানা খাত খোঁজা হচ্ছে। সেই উদ্দেশ্যে সর্বশেষ বিদ্যুৎ আর পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

এই মহা দুশ্চিন্তাসমৃদ্ধ খবরের মধ্যে একটি আশাবহ ও অর্থকরী খবর মিলেছে। সেটি হলো, দেশে নতুন একটি ব্যাংকের আবিষ্কার হয়েছে। এই ব্যাংকের কোনো নাম নেই, তবে ঠিকানা আছে। ঠিকানা ১১৯/১ লালমোহন সাহা স্ট্রিট, ঢাকা। এই ব্যাংকের মালিক দুই ভাই। আমানতকারীও তাঁরাই। তাঁদের আমানত রাখার জন্য সেখানে টাকার গুদাম আছে।

দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের খুব কম শাখা আছে, যেখানে নগদ ২০ কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার থাকে। কিন্তু দুই ভাইয়ের এই ব্যাংকে মিলেছে পাঁচটি সিন্দুক। এসব সিন্দুকে পাওয়া গেছে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর, প্রায় এক কেজি ওজনের স্বর্ণালংকার, ৯ হাজার ৩০০ ইউএস ডলার, ১৭৪ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ৫ হাজার ৩৫০ ভারতীয় রুপি, ১ হাজার ১৯৫ চায়নিজ ইউয়ান, ১১ হাজার ৫৬০ থাই বাথ ও ১০০ দিরহাম ইউএই।

এটিকে আপাতত আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাটাগরির ব্যাংক বলা যেতে পারে। ব্যাংকটির মালিক আমানতকারী দুই ভাইয়ের একজনের নাম এনামুল হক ওরফে এনু ও অন্যজনের নাম রুপন ভূঁইয়া। সেই হিসাবে ব্যাংকটির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘এনু-রুপন ব্যাংক’। এনু ছিলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক ও গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁর ভাই রুপন ভূঁইয়া ছিলেন ওই থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনো–কাণ্ডে র‍্যাব এই দুই ভাইকে ধরেছিল। সে সময় তাঁদের ও তাঁদের দুই কর্মচারীর বাসায় ৫ কোটি টাকা এবং সাড়ে ৭ কেজি সোনা পাওয়া গিয়েছিল।

বিপথগামী মানুষের জুয়ার নেশা থাকে। এই নেশার জন্য তারা বাড়িঘর বেচে দেয়। কিন্তু এই দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা দেখা গেছে। তাঁদের মূল পেশা জুয়া। আর নেশা হলো বাড়ি কেনা। জুয়ার টাকা দিয়ে তাঁরা গত সাত বছরে ২৪টি বাড়ি কিনেছেন। এসব বাড়ির ফ্ল্যাটসহ ঢাকায় ১২১টি ফ্ল্যাট ও ১২ প্লটে ৭২ কাঠা জমি আছে তাঁদের। এ ছাড়া পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে বলে তাঁরা সিআইডিকে জানিয়েছেন।

আরব্য উপন্যাসের আলীবাবা জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ৪০ চোরের যে খাজানা আবিষ্কার করেছিল, এই দুই ভাইয়ের খাজানা তার চেয়ে অনেক বড় মনে হচ্ছে। ৪০ চোরের খাজানার মূল ফটক খোলার ‘ভারবাল কোড নম্বর’ ছিল ‘চিচিং ফাঁক’। আর এই খাজানা, মানে এনু-রুপন ব্যাংকের ভল্ট খোলার কোড নম্বর তার চেয়ে অনেক কঠিন। হয়তো এ কারণেই ভল্ট খুলতে পাঁচ-ছয় মাস সময় লেগে গেল।

সফল হওয়ার কলাকৌশল নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য এই দুই ভাই রোল মডেল হতে পারেন। তাঁরা দুজনই হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। একসময় তাঁরা পুরান ঢাকায় লেদ মেশিনের দোকানে চাকরি করতেন। পরে খুলে বসেন লোহার শিটের ব্যবসা। পরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনোয় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। আক্ষরিক অর্থেই বস্তায় বস্তায় টাকা এসেছে তাঁদের বাড়িতে। দেশের হতাশ ও বেকার ছেলেপেলের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারেন তাঁরা।

সরকারের যেহেতু টাকা দরকার, সেহেতু তারা ‘এনু-রুপন ব্যাংক’-এর আদলে গড়ে ওঠা বাতেনি খাজানা খোঁজার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে। এই টাস্কফোর্স বাটি চালানের মতো মারফতি কায়দায় অনুসন্ধান চালিয়ে ঘাপটি মারা ব্যাংকগুলোকে বের করবে। এটা করা গেলে বাংলার জল-স্থল-অন্তরিক্ষ থেকে মাটির ব্যাংক থেকে শুরু করে অসংখ্য ‘এনু-রুপন ব্যাংক’ বেরিয়ে আসবে। সেই ব্যাংকগুলোর টাকা পেলে সরকারকে পাবলিকের তলপকেটে হাত দেওয়া লাগত না।

দুদিন আগে প্রথম আলোয় একটি শিরোনাম ছিল: ‘সংসার খরচ আরও বাড়ল’। সে প্রতিবেদনে লেখা, দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়ছে।...সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুৎ ও ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়াল সরকার।

সরকার জানে পাবলিকের ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তা-ই সয়’। সরকার জানে পাবলিকের পিঠে এক কিল পড়লে সে প্রথমে ব্যথায় কুঁকড়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু একেবারে পড়ে যাবে না। সে যখন আবার একটু সোজা হয়ে দাঁড়াবে, তখন আবার তার পিঠে কিল মারলে সে তা নিতে পারবে এবং একসময় তার পিঠ কিলসহনীয় হয়ে উঠবে।

বিদ্যুতের দাম বাড়া মানে দিন শেষে চাল-ডাল-আলু-পটোলের দাম বাড়া। দাম বাড়ার পর ‘পটোল কিনব নাকি তুলব?’—ভাবতে ভাবতেই আমজনতার দিন শেষ।

সরকারের কাছে অনুরোধ: আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকগুলো আবিষ্কার করুন। পাবলিককে পটোল কিনতে দিন, তুলতে দেবেন না। 

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin.ahmed@prothomalo.com