ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন; তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে ওই কলেজের ছাত্র–শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। শ্রোতাদের অনুরোধে তিনি বক্তৃতার অনেকটাই বলেন বাংলায়, যদিও বাংলা তাঁর ভাষা নয়। তাঁর বক্তৃতায় ‘উন্নয়নের জন্য রাজনীতি’র একটি সাদাসিধে বয়ান উঠে এসেছে।
নিজের রাজনীতিতে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি চিকিত্সা পেশা পরিত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগ দেননি, বরং চিকিৎসাসেবার প্রতি প্রবল আবেগের কারণেই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভের পর তিনি ভুটানে শল্যচিকিত্সা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে থাকেন। চিকিত্সার পাশাপাশি দেশব্যাপী মানুষের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে তাঁদের সমস্যা সম্বন্ধে অবহিত হন। তাই তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে তাঁর সিনিয়র ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ টান্ডি দরজির প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ‘দ্রুক ন্যাম্রুপ শগপা’য় (সামাজিক গণতন্ত্রী দল) যোগ দেন। উল্লেখ্য, ভুটানে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
কাদের নিয়ে এ দল?
লোটে শেরিংয়ের মন্ত্রিসভায় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেচেন ওয়াংমোকে রাজনীতিতে টেনে আনার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত দেচেন ওয়াংমো তখন আন্তর্জাতিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন। দুই দিন ভুটানে থাকেন তো তিন দিন বিদেশে থাকেন। তাঁকে রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে বললে দেচেন ওয়াংমো বলে ওঠেন, ‘নো ডক্টর, নো’। লোটে শেরিং হাল না ছেড়ে ভদ্রমহিলাকে বলেন, ‘আমাকে বলতে দিন, শুনে আপনার সিদ্ধান্ত দিন। যদি আমাদের দলে যোগ দেন ভালো। আপনার উত্তর না হলেও অসুবিধা নেই।’ এভাবেই অনিচ্ছুক, দক্ষ, তরুণ ও নিবেদিত ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে ওঠে তাঁদের রাজনৈতিক দল।
কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লোটে শেরিং বলেন, একই মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভুটানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজি আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজিও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
লোটে শেরিং বলেন, ২০১৩ সালে নির্বাচনে তাঁরা খুব খারাপভাবে হেরে যান, কিন্তু হতোদ্যম হননি। তাঁরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ না করে সারা দেশে দুইবার চষে বেড়ান, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। ভোট না চেয়ে তাদের বলেন, ‘আপনাদের অসুবিধা যদি এটা হয়, তবে আমরা সেটা এভাবে সমাধান করতে চাই।’ নির্বাচনে জনগণ তাঁদের দলকে বিজয়ী করে। এর একটি প্রধান কারণ ছিল যে তাঁদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল।
পরমতসহিষ্ণুতা
পার্টির প্রধান টান্ডি দরজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, তাঁদের মধ্যে কখনো মতবিরোধ বা ভুল–বোঝাবুঝি হয়নি। কেননা, তিনি বলেন, মতপার্থক্য কখনো ঠিক বা বেঠিকের বিষয় নয়। এটা মতামতের ভিন্নতার বিষয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি বলেন এটা সাদা, আমি বলি এটা অফহোয়াইট। এখানে অসুবিধা কোথায়?’ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমাদের চারটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আমি বলব, আমরা চারটি দলই হয় সমান ভালো অথবা সমান খারাপ।’
‘উচ্চাভিলাষী হওয়ার প্রয়োজন নেই’
শিক্ষার্থীদের খানিকটা অবাক করে তিনি বলেন, জীবনে সাফল্যের জন্য উচ্চাভিলাষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সবচেয়ে ভালো কাজটাই করে যাব। সমাজকে যা ভালো দেওয়া প্রয়োজন, তা–ই দিয়ে যাব। এর ফল ভালো হবেই।’ সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। তিনি ছাত্র–শিক্ষকদের বলেন, ভালো চিকিৎসক হওয়ার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। মাটি যদি ভালো হয়, তবে সেখানে যে বীজই রোপণ করা হোক না কেন, তা থেকে ভালো সার্জন, মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে। তাঁর বক্তৃতা থেকে প্রধান শিক্ষণীয় হলো, ভালো রাজনীতিবিদ, আমলা, চিকিৎসক, স্থপতি, প্রকৌশলী যে যা–ই কিছু হতে চান না কেন, সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে।
শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা
ছাত্রাবস্থায় একবার তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। প্রথমে ডাক্তাররা তাঁর সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। কিন্তু একজন সার্জারির অধ্যাপক তাঁকে দেখেই বলেন, আরে এর তো অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে। এখনই অপারেশন করতে হবে। সার্জারির এ অধ্যাপক ডা. খাদেমুল ইসলাম তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনিই তাঁকে অপারেশন করবেন, এ ধরনের অপারেশন তিনি অনেকবার করেছেন। তাঁর পিতা–মাতা অনেক দূরে। কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ নেই। তিনি তাঁকে সাহায্য করবেন। পরবর্তী সময়ে লোটে শেরিং তাঁর এ শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তাঁর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও সার্জন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি ভালো সার্জন হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়ার প্রয়োজনই শুধু উল্লেখ করেননি, এর উদাহরণ হিসেবে তাঁর দীক্ষাগুরু অধ্যাপক খাদেমুল ইসলামকে সামনে তুলে ধরেছেন।
বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচারী, পরমত অসহিষ্ণু, দুর্নীতিপরায়ণ ও অদক্ষ রাজনীতিবিদদের ভিড়ে নিউজিল্যান্ডে জেসিন্ডা আরডার্ন, কানাডায় জাস্টিন ট্রুডো, ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদো, মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ ও ভুটানে লোটে শেরিংয়ের মতো মানবিক সরকারপ্রধানের আবির্ভাব বিশ্বরাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে এনেছে। এ ধরনের দূরদর্শী ও মানবিক গুণসম্পন্ন সরকারপ্রধান নির্বাচিত করতে পেরে কতটাই না ভাগ্যবান ভুটান ও উল্লিখিত দেশগুলোর নাগরিকেরা। অবশ্য, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজির জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারার সূতিকাগার হিসেবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এবং আমরাও এ জন্য খানিকটা গর্ববোধ করতে পারি।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইডকল
fouzul.khan@gmail.com