মতামত

৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেন?

লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। প্রাথমিক জ্বালানির ওপর ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক-মূসক আদায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আত্মঘাতী নয় কি?
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ববাজারের রেকর্ড কম দামের বিপরীতে তেলের দাম ততটা না কমিয়ে সবশেষ পাঁচ মাস বাদে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বিপিসির লাভ যখন লিটারপ্রতি ১৫-৪০ টাকা ছিল, তখন বহু সমালোচনার পর এপ্রিল ২০১৬ সালে মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল! (সূত্র: লিটারে বিপিসির লাভ ১৫-৪০ টাকা; প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬)। এরপর ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ না পেয়ে কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা লোকসান দেখিয়ে এক ধাক্কায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হলো। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো কি গ্রহণযোগ্য হলো?

সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ আয়ও করে। লোকসানের হিসাবটা সরল নয়। লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। প্রাথমিক জ্বালানির ওপর ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক-মূসক আদায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আত্মঘাতী নয় কি? সরকারের আয় বাড়াতে পণ্য উৎপাদন খরচ এবং ব্যবসা সহজীকরণের প্রাথমিক ভিত্তিতেই বাধা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়?

গ্যাসপ্রাপ্তির সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার প্রভাব পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে, এটা আপাত সত্য, চূড়ান্ত সত্য নয়। এক বছরে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-পিডিবির লোকসান বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ, অঙ্কের হিসাবে ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। তথাপি, ভাড়ায় চালিত অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। বছরে এক মেগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেশ কিছু অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তির দোহাই দিয়ে ‘অপ্রমাণিত ও মিথ্যা সক্ষমতা’র বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লোকসান সমন্বয়ে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কমানোর উদ্যোগ নেই। নিজস্ব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে চার হাজার কোটি টাকার।

সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ আয়ও করে। লোকসানের হিসাবটা সরল নয়। লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। প্রাথমিক জ্বালানির ওপর ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক-মূসক আদায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আত্মঘাতী নয় কি? সরকারের আয় বাড়াতে পণ্য উৎপাদন খরচ এবং ব্যবসা সহজীকরণের প্রাথমিক ভিত্তিতেই বাধা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়?

পিডিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ ও চীন যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলেও সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতায় পূর্ণ সক্ষমতার ব্যবহার না হওয়ায় ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে বছরে ঘাটতি হচ্ছে ১৭০-১৮০ কোটি টাকা (শেয়ারবিজ, ২ নভেম্বর, ২০২১)। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরেই পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ খাতে মোট পরিশোধ করেছে রেকর্ড ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। সুতরাং গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলে বিপিসির প্রায় ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা লোকসানের কারণ শুধু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিই নয়, বরং সরকারি ভর্তুকির মূল উৎস বিদ্যুৎ খাতের অন্যায় চুক্তি, প্রয়োজনীয় চুক্তি নবায়ন, ক্যাপাসিটি চার্জ, ডিজেল ও ফার্নেস তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভুলভাল পরিকল্পনা এবং বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান, পাইপলাইন ও গ্যাস ক্রয় চুক্তিতে অদূরদর্শিতা।

বিপিসি পরিশোধিত-অপরিশোধিত তেল আমদানিতে একক মনোপলি কোম্পানি। ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু বিপিসির সিস্টেম লস ও দুর্নীতির থামানোর উদ্যোগ নেই। তেল চুরি এবং আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল ক্রয়ের নিয়মিত অভিযোগ আছে বিপিসির বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম শূন্য ডলারের কাছাকাছি ছিল অন্তত করোনাকালে দেড় বছর, ছিল শুধু জাহাজ খরচ। কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে সরাসরি তেল কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা বৈষম্যপূর্ণ। বিপিসির একক মনোপলি বন্ধ করে, কথা ছিল বিপিসি এবং বেসরকারি কোম্পানিরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনবে এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আমদানি করা তেলের মান, সিস্টেম লস, দুর্নীতি, তেলের ভেজাল মেশানো এবং পরিবেশগত বিষয় অডিট করবে। প্রাথমিক জ্বালানি আর কত দিন সরকারের আয়ের উৎস থাকবে? কিছুদিন পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে জ্বালানির দাম সঙ্গে সঙ্গে কমানো হবে কি?

অক্টোবরেই ১২ কেজির একেকটি সিলিন্ডারের মূল্য ১ হাজার ৩৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১ হাজার ২৫৯ টাকা। এখন এলপিজির দাম আবারও ১ হাজার ২৫৯ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩১৩ টাকা করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা পঞ্চম মাসে বাড়ল এলপিজির দাম। তেলের দাম বৃদ্ধির মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাস ভাড়া ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার ঘটনা ঘটছে। লঞ্চের ভাড়া দ্বিগুণ করার দাবিতে বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি। ভাড়া কত বাড়ানো উচিত এটা ঠিক হওয়ার আগে, জ্বালানি খরচ ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির যুক্তি কী—এই মীমাংসা হওয়া উচিত নয় কি? সরকার কি দাম বাড়ানোর আগে একটা গণশুনানি করারও ধার ধরেছে? সুশাসন ও জবাবদিহি আজ কোথায়?

সমুদয় অর্থনীতি প্রাথমিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু প্রাইমারি জ্বালানির দাম ২৩ শতাংশ বেড়ে গেছে (৫-৭ শতাংশ নয়) তাই বিদ্যুৎ পরিবহন শিল্প উৎপাদনসহ যাবতীয় পণ্য মূল্য ভাড়াসহ সমুদয় খাতে মূল্যবৃদ্ধির চক্র শুরু হয়ে যাবে। ডিজেল ও ফার্নেস তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে। ১২ বছরে সরকার পানির দাম ১৪, বিদ্যুৎ মূল্য ১২ এবং গ্যাসের দাম ৯ বার বাড়িয়েছে। গত সাত বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল- গ্যাসের মূল্য যখন নিম্নমুখী ছিল, তখন সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি কি সঠিক ছিল? তরল প্রাথমিক জ্বালানির আন্তর্জাতিক মূল্য নিম্নমুখী থাকার সময় সেকেন্ডারি জ্বালানির দাম উপর্যুপরি বাড়ানো হয়েছিল কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, বেশি হলে প্রাইমারি জ্বালানির দাম বাড়বে—এটা কি ব্যবসা ও জনবান্ধব কৌশল?

গত সাত বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল- গ্যাসের মূল্য যখন নিম্নমুখী ছিল, তখন সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি কি সঠিক ছিল? তরল প্রাথমিক জ্বালানির আন্তর্জাতিক মূল্য নিম্নমুখী থাকার সময় সেকেন্ডারি জ্বালানির দাম উপর্যুপরি বাড়ানো হয়েছিল কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, বেশি হলে প্রাইমারি জ্বালানির দাম বাড়বে—এটা কি ব্যবসা ও জনবান্ধব কৌশল?

মোট জ্বালানির ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩২ শতাংশ হচ্ছে তরল জ্বালানি। এমতাবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের যখন নাভিশ্বাস, জ্বালানির দাম বাড়া মড়ার ওপর নতুন খাঁড়া। কারণ, মূল্যবৃদ্ধির নতুন এক বিভীষিকাময় চক্র শুরু হয়েছে এতে। জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় একটা হারে বাড়ানোর। মহামারির মন্দা অর্থনীতিকে সচল করতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়ে বাজারে বাড়তি মুদ্রাপ্রবাহ করা হয়েছে, বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। তাহলে জ্বালানির দাম ৫ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির যুক্তি কী? যদি যুক্তি থাকে, তাহলে সরকারকে আগে মূল্যস্ফীতি সৎভাবে মাপতে হবে। মূল্যস্ফীতি পরিমাপের পুরোনো পদ্ধতিতে ত্রুটি এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানোর অভিযোগ আছে। ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর পাশাপাশি, ভর্তুকির অন্য খাতে সমন্বয়ের সুযোগ ছিল। ক্রস বর্ডার বিদ্যুৎ কমানো, তেল চুরি ও সিস্টেম লস কমানো, তেল ক্রয়ে দরপত্রের দুর্নীতি শোধরানো এবং অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনার সুযোগ ছিল।

২৩ শতাংশের মতো অসহনীয় হারে দাম বাড়ানোয় জনজীবনে অসহনীয় চাপ শুরু হবে। পত্রিকায় শিরোনাম উঠেছে, ‘দামে দিশেহারা ক্রেতা’, ‘এখন সংসার চালানোই দায়’। এসব প্রতিবেদনের পূর্বাপর মূল্য বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয়েছে যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর। কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন জ্বালানির সঙ্গে পরস্পর সংযুক্ত। এতে পণ্য মূলের ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে মানুষের বেতনের টাকার অবমূল্যায়ন ঘটবে। অর্থাৎ করোনার পর মানুষের আয়ের ক্রয়ক্ষমতা আরেক দফা কমে যাবে। এমনিতেই বেকারত্ব, নতুন দারিদ্র্যে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধার কষ্টও শুরু হয়েছে। জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের দাম সহনীয় হারে না বাড়িয়ে ‘অতি উচ্চহারে’র বৃদ্ধি বড্ড অযৌক্তিক ও গণবিরোধী।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর গ্রন্থের রচয়িতা। faiz.taiyeb@gmail.com