যুবকম্প শব্দটি বাংলায় কখনো শুনিনি, চোখেও পড়েনি। শব্দটি বাংলায় চালু করলে তা সবাই গ্রহণ করবে কি না, সেটাও বলা যায় না। অক্সফোর্ড ডিকশনারির সম্পাদকমণ্ডলী ২০১৭ সালের ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘ইয়ুথকোয়েক’ শব্দটি, এর বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘যুবকম্প’। তাদের হিসাবে ইয়ুথকোয়েক শব্দটির ব্যবহার ২০১৭ সালে ৪০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। সহস্রাব্দের প্রজন্ম এই বছরটিতে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের ধারার সূচনা করেছে, সেটাই তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণ।
যুবকম্প বা ছাত্র-যুব আন্দোলনের বিষয়টি বাংলাদেশে মোটেও নতুন নয়। বাংলাদেশের জন্মের পেছনেও ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। গণতন্ত্রের সংগ্রামেও ছাত্র-তরুণদের ভূমিকার ইতিহাস কম গৌরবের নয়। তরুণ-যুবকেরাই নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটিয়েছিলেন। তবে সহস্রাব্দের প্রজন্ম, ইংরেজিতে ‘মিলেনিয়ালস’ (কেমব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে জন্ম নেওয়া জনগোষ্ঠী) হিসেবে যাদের ভাবা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা এখনো খুব একটা স্পষ্ট ও জোরালো নয়। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে যে আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, তার রাজনৈতিক পরিধি বা আকাঙ্ক্ষা কতটা বিস্তৃত ছিল, তা এখনো গবেষণার বিষয়। তবে আন্দোলনটি সময়ের ধারায় থিতিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে বছরের আলোচিত শব্দ বা কথা বাছাইয়ের চল নেই। অভিধান প্রণয়নে বাংলাদেশে নেতৃত্বের আসনে থাকা বাংলা একাডেমির পক্ষে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়তো সম্ভবও নয়। রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে তাতে হয়তো এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন ধরনের বিতর্কের শিকার হতে হবে। আমাদের দেশে তরুণেরা যা-ই বলুন বা করুন না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও মাধ্যমগুলোতে জীবিত ও মৃত রাজনীতিকদের নাম যত বেশি উচ্চারিত হয়, তাতে নেতা-নেত্রীদের নাম শীর্ষে থাকার সম্ভাবনাই প্রবল। তবে রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে কোনো গুরুত্ববহ ঘটনা, বিষয় বা উপসর্গ বেছে নেওয়ার প্রশ্ন উঠলে সে রকম একটি তালিকা হতেই পারে। এ রকম তালিকা নিয়েও যে রাজনৈতিক বিতর্ক হবে সন্দেহ নেই। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের ‘তুমি আমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে’ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ বাংলাদেশে প্রকট। এখানে কোনো তৃতীয় বা চতুর্থ পক্ষ অথবা পক্ষহীন কোনো অবস্থানের বাস্তবতা স্বীকার করা হয় না।
এসব বিতর্কের সম্ভাবনা সত্ত্বেও ২০১৭-এর যেসব ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, গুরুত্ব বিবেচনায় সেগুলোর যদি কোনো তালিকা করা হয়, তাহলে তাতে ষোড়শ সংশোধনী, গুম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ধর্ষণ, রোহিঙ্গা সংকট ও ডাকসু নির্বাচনের দাবির মতো বিষয়গুলোকে স্থান দিতে হবে। অবস্থানক্রমে কিছুটা হেরফের হয়তো হবে, কিন্তু বছরজুড়ে এসব কথাই আমাদের ভাবনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল।
ষোড়শ সংশোধনী নিতান্তই আইনের বিষয় হিসেবে মনে হলেও বছরের অনেকটা সময় জুড়ে যেমন তা জন-আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, তেমনি এর গুরুত্বও অপরিসীম। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ নিজেদের হাতে নেওয়ার বিধান করে এই সংশোধনীটি করে ২০১৪ সালে। এই সংশোধনীর সমালোচনায় কথা ওঠে যে এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবীদের করা এক মামলায় ২০১৬ সালে হাইকোর্ট এটিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিলে বিচারপতিরা সংসদে সমালোচিত হন। তবে তখনো বিতর্ক ও সংকট অতটা তীব্র হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালের জানুয়ারিতেই সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং দীর্ঘ শুনানির পর জুলাই মাসে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখেন। যদিও হাইকোর্টের কিছু পর্যবেক্ষণকে আপিল বিভাগ বাতিল করে দেন, কিন্তু আগস্টে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ষোড়শ সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা আপিল বিভাগেও বহাল থাকার পর সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, এমনকি অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন। এসব অভিযোগের মুখে চিকিৎসাজনিত ছুটিতে গিয়েও তিনি অসুস্থতার কথা অস্বীকার করে বিদেশে যান এবং পদত্যাগে বাধ্য হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটিই কোনো প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের প্রথম ঘটনা। কোনো রায় ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনও এই প্রথম। বিচারপতি সিনহার বিদায়ের পর অধস্তন আদালতের বিচারকদের ব্যাপক হারে বদলির ঘটনা ঘটে এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণভার সুপ্রিম কোর্টের হাত থেকে নির্বাহী বিভাগের হাতে স্থানান্তরিত হয়। সরকার বাহাত্তরের আদি সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটির বিষয়ে মূল সংবিধান থেকে সরে এসে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেন্দ্রিক ষোড়শ সংশোধনী বিতর্কের গুরুত্ব তাই যে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছেছে, সেই নিরিখে বছরের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের তালিকায় একে স্থান না দিয়ে উপায় আছে কি?
২০১৭ সালের আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় গুম বা ‘নিখোঁজ’। এটি একটি আতঙ্কেরও বিষয়। সম্ভবত ২০১৭ সালেই সর্বাধিক ৭৫ জন গুম/নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ফিরে এসেছেন ৩৫ জন, মরদেহ পাওয়া গেছে ৭ জনের এবং ৩৩ জনের ভাগ্য সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যাচ্ছে না (গুম আতঙ্কে বছরজুড়ে অনেকেই নির্ঘুম, প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭)। যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৬ জনকে নিখোঁজের পর বিভিন্ন সময়ে, এমনকি মাসাধিককাল পরে পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করেছে। তবে কাগজে-কলমে গ্রেপ্তার দেখানো হয় আগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁরা কথা বলছেন না আতঙ্কের কারণে। ফৌজদারি অপরাধীরা কাউকে অপহরণ করে থাকলে সেখানে কোনো লেনদেন ছাড়া তাঁরা ফিরে আসতে পারতেন না। এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লেনদেন ঘটার কথা জানা যায় না। তাঁর কথায় ‘এখন তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীকেই আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। রাষ্ট্রকেই এখন প্রমাণ করতে হবে যে তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।’ (ফিরছেন নিখোঁজরা, মুখ খুলছেন না, ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭)।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য গুমের বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়ে এসব ব্যক্তিকে নিখোঁজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে পুলিশের তৎপরতার কারণে তাঁরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, পুলিশ উদ্ধার করেনি। আগের কয়েক বছর গুম/নিখোঁজ হয়েছেন প্রধানত সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। এরপর জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সন্দেহভাজনরা। কিন্তু সর্ব সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক ও কূটনীতিক। ফলে সমাজের নানা পর্যায়ে তৈরি হয়েছে একধরনের আতঙ্ক। বছরের আলোচিত শব্দের তালিকায় তাই গুমের অন্তর্ভুক্তি অবধারিত।
বিব্রতকর সত্য অস্বীকার করা রাজনীতিকদের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফলে বছরের পর বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সমস্যাটিকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সত্য অস্বীকারের পরিণতিতে এখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা—কোনো পরীক্ষাই এই অপচর্চার কলুষ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু সরকার প্রথম খড়্গহস্ত হলো গণমাধ্যমের ওপর। কথিত গুজব প্রকাশের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রয়োগের হুমকি দেওয়া হলো। সর্ব সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী এর জন্য শিক্ষকদেরই দায়ী করেছেন। পুলিশি তদন্তে অবশ্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গেও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয়টি উঠে এসেছে। ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কর্মীদের সম্পৃক্ততায় এই রাজনৈতিক প্রভাবের ছাপ মেলে। কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর সত্য অস্বীকারের ঘোরে থাকলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস যে ২০১৭ সালে বহুল আলোচিত ছিল, তা আমাদের মানতেই হবে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং এ কারণে সৃষ্ট অসহায় আশ্রয়প্রার্থীদের ঢল বছরটির একটি স্মারকচিহ্ন হয়ে গেছে, সন্দেহ নেই। প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের এক অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ এখন বাংলাদেশের সামনে। রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়, আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানো, গণহত্যা, ধর্ষণ, জাতিগত হত্যার বিচার ইত্যাদি প্রসঙ্গ ঘিরে বারবারই রোহিঙ্গাদের কথা আলোচিত হচ্ছে গত আগস্ট থেকে। কিন্তু নতুন আসা আশ্রয়প্রার্থীসহ দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের কাঁধে চাপলেও সমস্যাটির সমাধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। সেই বিবেচনায় রোহিঙ্গা সংকটকে তালিকায় একটু পেছনের দিকেও রাখা যায়।
২০১৭ সালে আমাদের জন্য খুবই লজ্জার ও মর্মপীড়ার একটি বিষয় ছিল ধর্ষণ। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় এই জঘন্য অপরাধের খবর ছাপা হয়েছে। একেবারে ছোট শিশুও এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হয়েছে। নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য নানা ধরনের প্রচারাভিযান চললেও অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটি ভীষণভাবে দুর্বল থেকে গেছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হলো নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর আন্দোলনবিমুখতা। কয়েক দশক আগে দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে যে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল, সে রকম কিছু এখন আর দেখা যায় না।
শুরুতে যে যুবকম্পের কথা বলেছিলাম, সেই তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে, অবশ্য প্রধানত ঢাকায়, ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই কিছুটা গণতান্ত্রিক চর্চার আকুতি লক্ষ করা গেছে। একাধিকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। সর্ব সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ১৩ দিন অনশন করেছেন ওয়ালিদ আশরাফ নামের এক তরুণ। একজন ওয়ালিদের অনশন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। ওয়ালিদ যদিও সহস্রাব্দের প্রজন্মের নন, কিন্তু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর এই অঙ্গীকার তাঁর উত্তরসূরিদের উদ্বুদ্ধ করবে, অনেকেই অন্তত সেটুকু আশা করেন।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।