সারা বিশ্ব অতিমারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের সালতামামি বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণের অবকাশ থাকলেও অন্তত বিশ্বব্যাপী তিনটি নির্ধারণী প্রবণতা লক্ষণীয়। অতিমারি বা মহামন্দাকালে পুরোনোকে ভেঙে একটি সৃজনশীল নতুন পন্থার দিকেও যাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের তিন মূলস্তম্ভ—সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে ভবিষ্যৎমুখী বাংলাদেশের জন্য নতুন ধরনের পথনকশাও তৈরি হতে পারে।
অতিমারি থেকে উত্তরণবিষয়ক অনেকগুলো অনুমিতি হাজির করা হয়েছিল। পরিসংখ্যানগত গোঁজামিল থাকলেও তিনটি প্রবণতা উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, ভাইরাসের নতুন প্রকারের সংক্রমণগত হার বাড়লেও পরীক্ষা ও টিকার হার যেখানে বেশি, অর্থনৈতিক কার্যক্রম সেখানে বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, সরকারের রাজস্বগত সক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের গতিপথের মধ্যে ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। তৃতীয়ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী, সামাজিক প্রতিরক্ষণব্যবস্থা ও প্রাক্-কোভিডকালীন ঝুঁকি পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের গতিপথ নির্দেশ করবে। ফলে দেশের সঙ্গে দেশের এবং দেশের ভেতরে বৈষম্য বাড়বে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চলকসমূহের মধ্যে বৈসাদৃশ্যের কারণে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
গড়ের হিসাব সেকেলে। মানুষের আয়ের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেশি থাকলে গড় ব্যবহার করে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে না। মধ্যক বা অধিকাংশের হিস্যা দরকার। সংকট থেকে উৎপন্ন বহুমুখী পার্থক্যমূলক নেতিবাচক প্রভাব নির্মূল না করায় দরিদ্র, দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিতদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত দরিদ্রে পরিণত হয়েছে; দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। কিন্তু সম্পদের কেন্দ্রীভবনে গোষ্ঠীতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়েই চলছে। অতএব অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল কাজ করবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল কাজ করে যেখানে পিছিয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা কম। অধিকাংশ পিছিয়ে পড়লে সর্বজনীন কৌশলই একমাত্র পন্থা। ইতিহাসও তাই বলে। মহামন্দা থেকে মার্কিনরা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপ থেকে ইউরোপ মোটাদাগে এভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
এ বছরটা শুরু হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। করোনাকালীন ভোগান্তিতে রিপাবলিকানদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাদা বর্ণের জনগণ ১৯৯৬ সালের নিবন্ধিত ভোটারের ৮৫ শতাংশ থেকে কমে ৬৯ শতাংশে নেমে এলেও সাদাবাদী রাজনীতি এখনো প্রকট। এখনো সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দেশব্যাপী আইন কংগ্রেস পাস করেনি। সাদা বর্ণপ্রধান রাজ্যগুলো বিভিন্ন ভোটাধিকার নিবারণকারী আইন পাস করে যাচ্ছে। পুঁজির আধিপত্য প্রবল। ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ আইন পাস করতে হিমশিম খাচ্ছে। এত কিছুর মধ্যেও নির্বাচনে হেরে ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ হলেও মার্কিন প্রতিষ্ঠানসমূহ নিশ্চিত করল যুক্তরাষ্ট্রে কেবল সংবিধান অনুসরণ করা হয়, কোনো ব্যক্তি বা স্বৈরশাসকের নির্দেশ নয়। অর্থাৎ, চলমান পৃথিবীব্যাপী মেরুকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখতে হলে মধ্যপ্রাচ্য বা আফগানিস্তানের আলোকে ‘ওয়ার অন টেরর’ বা অনন্যনীতি কাজ করবে না। সংবিধানভিত্তিক কৌশল তথা গণতন্ত্রই একমাত্র সম্বল। সে লক্ষ্য থেকেই গণতন্ত্র সম্মেলন।
এশিয়া-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের ক্ষেত্রে জানা-অজানা দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এ অংশীদারত্বের ৩ নম্বর ধাপ চলছে। প্রথমে নাম ছিল পিভট টু এশিয়া, তারপর এল ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, আর এখন বলা হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। মজার বিষয় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো তার কৌশলটি পরিষ্কার করেনি। অন্যদিকে চীন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বড় রকমের উল্লম্ফন ঘটাচ্ছে। বড় ধরনের বৈষম্য থাকলেও চীন এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা ন্যায্যতা আনার চেষ্টা করছে। আবার চীন অন্তত তিন ধরনের বৈপরীত্যকে সমাধান করতে পারছে না। প্রথমত, চীন মনে করছে তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হবে। অথচ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো উন্নয়নশীল দেশ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, একটি দেশের পরাশক্তি হতে গেলে তার সফট পাওয়ার লাগে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকারের কথা ফেরি করে। চীন শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপরই জোর দিচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু বন্ধু তৈরি করতে পারে না। বন্ধুত্ব তৈরি করতে না পারলে সম্পর্কের নরম্যাটিভ লেজিটিমেসি বা আদর্শিক বৈধতা তৈরি হয় না। তৃতীয়ত, চীনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কৌশলগত সাফল্যের পরিচয় দিলেও সফট পাওয়ার বাস্তবায়ন করার জন্য দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা দেখাতে পারছে না।
অন্যদিকে পাশ্চাত্যবাদীরা ভারত নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও ভারতের সীমাবদ্ধতা কোভিডকালে প্রকট হয়েছে। ভারতের ওপর আশা করা হয়েছিল ভারত শুধু নিজের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার আগে করবে না; সারা পৃথিবীকে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে নিজের স্থান করে নেবে। ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। আর কেউ চীনের সঙ্গে ভারতকে তুলনা করছে না। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য—ভারতীয় রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান দিলেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা আঞ্চলিক পর্যায়েও পড়বে।
শিল্পবিপ্লবের যে যাত্রা ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় শক্তির ইতিবাচক রূপান্তর কিন্তু বিশ্ব দেখেনি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা এবং কোনোক্রমেই ২ ডিগ্রির বাইরে যেতে না দেওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৬)। শেষে কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকারনামা (এনডিসি) মূল্যায়ন করে জানা যায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এ তাপমাত্রায় পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে না।
২০২২ সালে বিশ্ব ইতিহাসে পরিবর্তন আনার একটি সুযোগ সৃষ্টি জরুরি। এ বছর পরিবেশবিষয়ক বিশ্বব্যাপী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনের সুবর্ণজয়ন্তী। জলবায়ু সংকট, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি এবং করোনা মহামারির মতো ত্রিবিধ সংকটের মুখে আজ বিশ্ব উপনীত হয়েছে। আসছে দশক বিশ্বমানবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ৫১ বছরে পা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা অপরিসীম। তাদের মধ্যে সমরূপতাও আছে। এ অর্থে বাংলাদেশের উত্থানটা অন্য দেশের চেয়ে সহজ হওয়ার কথা। বাংলাদেশ ৫০০ বিলিয়ন নয়; এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে পারে। আমাদের হিসাবে ২০৩৬ সাল নাগাদ তা সম্ভব। এগিয়ে যেতে হলে কতগুলো প্রয়োজনীয় ও দরকারি শর্ত পূরণ করা জরুরি। প্রয়োজনীয় শর্তগুলোর একটি হলো উৎপাদনের উপকরণসমূহের কার্যকর ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে পুঁজি গঠন ত্বরান্বিত করা জরুরি। শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ালে তাদের মজুরিও বাড়বে। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও গবেষণা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫-৬৫ বছরের কর্মক্ষম জনশক্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। যদি তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়, এ পরিমাণ কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এক বিরাট সম্পদ। একে ‘জনমিতিক লভ্যাংশ’ বলা হয়। অতএব ‘জনমিতিক লভ্যাংশ’ হতে বাংলাদেশের মৌল অর্থনৈতিক কৌশল।
অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে উন্নয়ন ও সামরিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে এমন গতি বজায় রাখা, যা যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিণতি সম্পর্কে ভয় জাগিয়ে তুলবে এবং এ ধরনের ঘটনাকে নিরুৎসাহিত করবে। অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য বা ক্রেডিবল পাওয়ার হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। কারণ, নির্ভরযোগ্য শক্তি না হলে কোনো কিছুই কাজ করবে না। ছোট দেশ হলেও সিঙ্গাপুর এ ধরনের ডেভেলপমেন্ট ডিটারেন্সের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে পররাষ্ট্রনীতির মৌল কাঠামো হবে শান্তির বঙ্গোপসাগর আর প্রতিরক্ষানীতি আবর্তিত হতে হবে ডেভেলপমেন্ট ডিটারেন্সকে বিবেচনায় নিয়ে। আর এ জন্য অপরিহার্য আদর্শিক বৈধতা। অর্থাৎ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকারব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সারা বিশ্ব যখন পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তখন প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ না করে, হিসাব–নিকাশের রাজনীতিই বাংলাদেশ ডকট্রিন বা বাংলাদেশের নীতির মূল বিষয় হওয়া দরকার।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন