একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ২৮৫টি কেন্দ্রে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে কোনো ভোটই পড়েনি। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকেও কোনো ভোট পড়েনি দুটি কেন্দ্রে। এ ছাড়া ৬ হাজার ৭৫টি কেন্দ্রে ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে ধানের শীষ।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পেয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। যদিও ভোটের দিন গণনা শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেওয়া কেন্দ্র ফল অনুযায়ী, নৌকা প্রতীকে শূন্য ভোট পড়েছে শুধু একটি কেন্দ্রে, যেখানে নৌকা প্রতীকে ভোট করেছেন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী।
সুজনের বিশ্লেষণে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও মিত্র দলের প্রার্থীরা নৌকা এবং লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এর বিপরীতে বিএনপি জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একক প্রতীক ছিল ধানের শীষ। যদিও মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় ঐক্যফ্রন্ট–সমর্থিত দুজন প্রার্থী উদীয়মান সূর্য (গণফোরামের প্রতীক) নিয়ে অংশ নেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই জোটের প্রাপ্ত ভোটে বিরাট ফারাক খুঁজে পেয়েছে সুজন।
সুজনের বিশ্লেষণে এসেছে, ২২টি কেন্দ্রে ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে নৌকা। ধানের শীষের এ দশা হয়েছে ৬ হাজার ৭৫টি কেন্দ্রে। ধানের শীষের প্রার্থীরা ১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৫০১টি কেন্দ্রে, অন্যদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ২৩টি কেন্দ্রে। ধানের শীষের প্রার্থীরা ২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৫৩৫টি কেন্দ্রে আর নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ২৯টি কেন্দ্রে।
৪০ হাজার ১৫৫টি কেন্দ্রের ফল বিশ্লেষণ করে সুজন বলছে, অধিকাংশ কেন্দ্রেই নৌকা ও ধানের শীষের ভোটের পার্থক্য অস্বাভাবিক।
১ হাজার ২৮৫ কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে শূন্য ভোট পড়ার কারণ জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ভোটই তো হয়নি। সরকারি দল পুলিশের সাহায্যে আগের রাতেই সব ভোট মেরে দিয়েছে। সুতরাং শূন্য ভোট বলেন আর শতভাগ ভোট বলেন, তাতে কী আসে যায়।
তবে শূন্য ভোটের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪–দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি শুরু থেকেই পিটটান দিয়েছে, প্রার্থীরাও মাঠ থেকে সরে গেছেন। তাঁরা আগাম পরাজয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন। অনেক জায়গায় মাঠেই নামেননি, কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেননি। তাই তাঁদের পক্ষের ভোটাররাও ওই কেন্দ্রগুলোতে ভোট দিতে আসেননি।
নৌকা প্রতীকেও শূন্য ভোট
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সুজন বলেছে, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দুটি ভোটকেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন। কেন্দ্র দুটি হচ্ছে ঠাকুরগাঁও-৩-এর হাটপাড়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্র এবং মাগুরা-২–এর থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সব বৈধ ভোট ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন; যদিও ওই আসনে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
তবে প্রথম আলোর মাগুরা প্রতিনিধি জানান, ভোটের দিন গণনা শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তার সই করা ফলাফল অনুযায়ী, থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা নয়, শূন্য ভোট পেয়েছে ধানের শীষ। সেখানে বৈধ ভোটের শতভাগই পেয়েছে নৌকা।
এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও-৩–এ বিজয়ী হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী। নৌকার পক্ষে ভোট না পড়া কেন্দ্র হাটপাড়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং মোটরগাড়ি প্রতীকে ২৯ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রথম আলোর পীরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মো. ইয়াসিন আলী। কিন্তু সেখানে সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এমদাদুল হক মোটরগাড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তিনি ছিলেন ধানের শীষের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। মাত্র ৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। এ ছাড়া লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। এখানে ভোট নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল মহাজোটের তিন নেতার মধ্যে।
যে ফল অনেকের কাছেই বিস্ময়কর
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন আসনের ফলাফলে নৌকা প্রতীকের বিপরীতে ধানের শীষের যে ভোট দেখা যাচ্ছে, সেটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যত ভোট পেয়েছেন, বিএনপির প্রার্থী তার মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া ফলাফলে দেখা গেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগ হচ্ছে, অধিকাংশ আসনে ভোটের আগের রাতে নৌকায় সিল দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছিল।
কয়েকটি আসনে ভোটের পর্যালোচনা করে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বিএনপির রুমানা মাহমুদ ও আওয়ামী লীগের হাবিবে মিল্লাত। হাবিবে মিল্লাত পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮০৫ ভোট। অন্যদিকে রুমানা মাহমুদ পেয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার ৭২৮ ভোট। অর্থাৎ বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৭ ভোট বেশি পেয়েছে। অথচ এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির রুমানা মাহমুদ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বিবিসির ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, নরসিংদী-২ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান ১৯৯১ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন। ২০০৮ সালে এ আসনে বিএনপি পরাজিত হলেও আবদুল মঈন খান ৭০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার তিনি পেয়েছেন মাত্র ৭ হাজার ১০০ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোট।
সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। সিলেট-১ আসনটিতে অধিকাংশ ভোটার সিলেট মহানগর এলাকায় বসবাস করেন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একই জায়গায় বিএনপির প্রার্থী কীভাবে এত বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন, সেটি অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে।
এদিকে গত ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এসেছে, ভোটের ব্যবধানে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবারের নির্বাচন। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যেখানে ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, সেখানে বিএনপি জোট পেয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট। অথচ এর আগের নির্বাচনগুলোতে এই দুই দলের ভোট ছিল প্রায় সমান। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ৪টিতে জিতেছিল। সেবার তারা চট্টগ্রামে ৪৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ জোট জিতেছিল ১১টি আসনে। তাদের ভোট ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ওই ১৬টি আসনেই আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীরা জয়ী হন। এবার আওয়ামী লীগ জোট মোট প্রদত্ত ভোটের ৮৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট পায়। অন্যদিকে ১৬টি আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ ভোট। জামানত হারিয়েছেন ১০ জন প্রার্থী।
মহিউদ্দিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক