মতামত

হেফাজতে মৃত্যু বেআইনি, কিন্তু বিচার হয় না কেন

ঘটনার বৃত্তচক্র একই রকম, জায়গার নাম বদলায়, মূল চরিত্রের নাম বদলায়, সময় বদলায়; কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়াহীনতা বদলায় না, অস্বীকারের সংস্কৃতি বদলায় না। আর যা বদলায় না, তা হচ্ছে আহাজারি। বরিশালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তারের তিন দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র রেজাউল করিম ওরফে রেজার (৩০) ‘মৃত্যুর’ সংবাদ আমাদের আবার বৃত্তচক্রের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। কিছু প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু নির্লিপ্ত মানবাধিকার কমিশন; যেমন ছিল গত বছরগুলোতে ২০১৭ সালে, ২০১৮ সালে, ২০১৯ সালে, ২০২০ সালে। একে একটি ‘ঘটনা’ বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। যেমন বিবেচনা করা হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদ, কিংবা ২০১৮ সালের মার্চ মাসে রমনা থানায় ‘নিহত’ জাকির হোসেনের ‘মৃত্যু’। জাকির হোসেনকে পথ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৬ মার্চ। তিন দিন রিমান্ডে ছিলেন, তারপর তাঁর মৃত্যু ঘটে ১১ মার্চ।

নিহত রেজার পরিবার বলেছে, রেজা পুলিশি নির্যাতনে মারা গেছে। ঘটনার যতটুকু জানা গেছে, তার সারাংশ হচ্ছে, ২৯ ডিসেম্বর রাত আটটার দিকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহি রেজাউলকে চায়ের দোকান থেকে আটক করেন। আটক করার পরের দিন তাঁকে জেলে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। তাঁর বাবা ইউনুস মুন্সী দাবি করেছেন, আটকের সময় রেজাউল সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। তিনি আরও বলেছেন, ‘শুক্রবার রাত নয়টার দিকে আমাকে পুলিশ ফোন করে জানায়, রেজাউল বাথরুমে পড়ে রক্তক্ষরণ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশের নির্যাতনেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে।’ আরেক আত্মীয় আবদুল বারেক বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে গিয়ে রেজাউলের পা, বুক, ঘাড়ে লাঠি দিয়ে আঘাতের জখম পেয়েছি। তার পায়খানা ও প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।’

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা যান, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা যান ৭৮ জন। এই সব মৃত্যু এখন পরিসংখ্যান মাত্র। কিন্তু প্রতিটি পরিবারকে প্রশ্ন করে দেখুন, এই মানুষগুলো কেবল পরিসংখ্যান কি না। আমার-আপনার নিকটজনদের যদি এভাবে জীবনাবসান হতো, আমাদের জীবনেও কি তাঁরা কেবল পরিসংখ্যান হতেন?

আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে যে ২০২০ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে, অর্থাৎ গ্রেপ্তারের পর নিহত হয়েছেন ১১ জন। এ ছাড়া গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছেন ৫ জন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন ৮ জন। ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মোট ১৮ জন মারা গিয়েছিলেন; ২০১৮ সালে ১৭ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা যান, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা যান ৭৮ জন। এই সব মৃত্যু এখন পরিসংখ্যান মাত্র। কিন্তু প্রতিটি পরিবারকে প্রশ্ন করে দেখুন, এই মানুষগুলো কেবল পরিসংখ্যান কি না। আমার-আপনার নিকটজনদের যদি এভাবে জীবনাবসান হতো, আমাদের জীবনেও কি তাঁরা কেবল পরিসংখ্যান হতেন?

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। ২০০৩ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে এই নিয়ে সুস্পষ্ট বাধার কথা বলা হয়েছিল, ১৩ বছর লেগেছিল এই বিষয়ে সরকারের আপিল নিষ্পত্তি করতে, ২০১৬ সালের মে মাসে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল, ১০ নভেম্বরে পূর্ণ রায় প্রকাশিত হয়, সেখানে ১৬৪ ধারার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে সরকারের হেফাজতে থাকার সময় কারও ওপর নির্যাতন করা যাবে না।

বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি। গত সেপ্টেম্বরে এই মামলার রায় ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের কেউ কেউ একে আইনের শাসনের উদাহরণ এবং সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু গত সাত বছরে কমপক্ষে ৩০৬ জন মারা গেছেন, বিচার হয়েছে একটি, সময় লেগেছে সাড়ে ছয় বছর। সেই বিচারের জন্য পরিবারকে লড়তে হয়েছে, পুলিশ মামলা নেয়নি, পরিবারকে দেখানো হয়েছে ভয়ভীতি-প্রলোভন। ভয়ভীতি দেখানোর পর তারা ২০ লাখ টাকায় আপসের প্রস্তাব দিয়েছিল, জানিয়েছেন নিহত মোহাম্মদ জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি (বিবিসি, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়। ২০১৮ সালে নিহত জাকির হোসেনের চাচা বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমাদের পেছনে ডিবির লোক, পুলিশের লোক, আমরা তো ময়নাতদন্ত করতে পারিনি। কোনোরকম লাশ বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের, আমি চাচা হিসেবে সাইন করেছি। এরপর যখন মিলনের জানাজা হয়, সেখানে অনেক পুলিশ এবং সাদাপোশাকে ডিবির লোক ছিল। তাই ভয়ে অনেকেই জানাজায় আসেনি (বিবিসি, ২৩ মার্চ ২০১৮)।’

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।

এই সব ঘটনা বাংলাদেশের সরকার বা আদালত জানেন না, তা মনে করার কারণ নেই। দুর্ভাগ্য এখানে যে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে একধরনের বৈধতার চাদর দিয়ে মুড়ে দিতে উৎসাহীর অভাব হয় না। রেজাউল করিম রেজার মৃত্যুর খবর ছাপার ধরনের মধ্যেও তার লক্ষণ স্পষ্ট। পুলিশ নিহত রেজার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তিনি ‘মাদক ব্যবসায়ী’। যেন মাদক ব্যবসায়ী হলে হেফাজতে মৃত্যুর বৈধতা তৈরি হয়।

সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য। পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যার ঘটনা বিষয়ে র‍্যাবের করা তদন্তের ভিত্তিতে আদালতে যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে এই হত্যার ঘটনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল টেকনাফ থানায় বসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ১৫ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে থানায় বসে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হতে পারে না, হবে না। হেফাজতে হত্যার ঘটনাগুলো ঘটে থানায়ই। পুলিশপ্রধানের এই বক্তব্য কি হেফাজতে মৃত্যুর জন্যও প্রযোজ্য নয়?


আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট